অতিরিক্ত লবণ খাওয়া উচ্চ রক্তচাপের অন্যতম কারণ। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, লবণ খাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি ৫০ শতাংশ কমে আসবে। ফলে কমবে মৃত্যুঝুঁকিও।
প্রতিদিন একজন মানুষের ৫ গ্রাম অর্থাৎ এক চা চামচ পরিমান লবণ খাওয়া দরকার। দেখা যায়, বেশিরভাগ মানুষ এর কয়েকগুণ বেশিমাত্রায় লবণ গ্রহণ করেন। শুধু ভাত-তরকারিতে নয়, না জেনে বাইরের খাবার থেকেও মাত্রাতিরিক্ত লবণ গ্রহণ করছেন। এ কারণে দিন দিন বাড়ছে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুঝুঁকি।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা থেকে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ মানুষ সপ্তাহে অন্তত একবার প্রক্রিয়াজাত করা প্যাকেটজাত খাবার খায়। আর প্যাকেটজাত ৬২ শতাংশ খাদ্যে উচ্চমাত্রায় লবণের উপস্থিতি রয়েছে, যা হৃদরোগ, কিডনি বিকলসহ বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
গবেষণার বিষয়ে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রেজিস্ট্রার (ক্লিনিক্যাল রিসার্চ) ডা. শেখ মোহাম্মদ মাহবুবুস সোবহান বলেন, দেশের বাজারে বিদ্যমান প্রক্রিয়াজাত করা খাদ্যে লবণের উপস্থিতি নির্ণয়ে ২০২১ সালের জুন থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত আট বিভাগীয় শহর থেকে ১ হাজার ৩৯৭ ধরনের প্রক্রিয়াজাত করা প্যাকেটজাত খাবারের নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
এর মধ্যে ১০৫ ধরনের খাবার ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, সেখানে ৬২ শতাংশ খাবারে অধিক মাত্রায় লবণ রয়েছে। এর মধ্যে ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ খাবারে অত্যধিক এবং ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ খাবারে বেশি লবণের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক ৫ গ্রাম লবণ প্রয়োজন। সেখানে বাংলাদেশের মানুষ ৯ গ্রামের বেশি লবণ গ্রহণ করছে।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটল অ্যান্ড রিসার্স ইনস্টিটিউটের উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ প্রোগ্রামের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মাহফুজুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ বন্ধ করতে পারলে ৫০ শতাংশের উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমে যেত। একজন মানুষের প্রতিদিন ৫ গ্রাম লবণ প্রয়োজন অর্থাৎ এক চা চামচ কিন্তু তার বেশি খাচ্ছেন। জেনে খাচ্ছেন আবার না জেনেও খাচ্ছেন। ঘরে তিনি জেনে খাচ্ছেন। আর ঘরের বাইরে যে খাবার খাচ্ছেন, তাতে কি পরিমাণ লবণ আছে, তা না জেনেই খাচ্ছেন।
তিনি বলেন, একটি চিপসে ১০ গ্রাম লবণ থাকে। তা অনেকেই জানেন না। মানুষ রেস্টুরেন্টে বিভিন্ন খাবার খাচ্ছেন, তাতে কী পরিমাণ লবণ রয়েছে তা তিনি না জেনেই খাচ্ছেন। ফলে শরীরে ঢুকছে মাত্রাতিরিক্ত লবণ।
২০১৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের ‘মিরপুর বাউনিয়া বস্তি’ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন একজন মানুষ ৭ দশমিক ৮ গ্রাম লবণ খায়। এ গবেষণায় আরও দেখা গেছে, যাদের উচ্চরক্তচাপ নেই তারা খায় ৯ দশমিক ২ গ্রাম। আর যাদের আছে তারা খায় ৮ দশমিক ৪ গ্রাম।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. খালেকুজ্জামান জানান, কতটুকু লবণ খাওয়া যাবে তার যদি একটা গাইডলাইন থাকতো তাহলে মানুষের জানতে সুবিধা হতো। গাইডলাইন না থাকায় তারা যেমন খুশি তেমন খায়। ফলে উচ্চ রক্তচাপের রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলছে।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য পাঁচ গ্রামের বেশি লবণ না খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের হাইপারটেনশন কন্ট্রোল প্রোগ্রামের (জাতীয় কর্মসূচির) ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার এবং হাসপাতালের ডিপার্টমেন্ট অব এপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চের রিসার্চ ফেলো ডা. শামীম জুবায়ের।
তিনি বলেন, মানবদেহের জন্য লবণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা উপাদান। এককভাবে উচ্চ রক্তচাপ ও স্ট্রোক নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে লবণের পরিমিতি বোধ। একজন সুস্থ মানুষ কাঁচা লবণ বা রান্নায় ব্যবহৃত লবণসহ সারা দিনে ৫ গ্রাম খেতে পারবে। অথচ দেশের মানুষ দিনে প্রায় ৯-১০ গ্রাম লবণ খান।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, উচ্চ রক্তচাপের জন্য এনভায়রনমেন্টাল যেসব ফ্যাক্টর কাজ করে তার মধ্যে অন্যতম হলো লবণ। আমাদের দেশের গ্রামীণ বা শহর অঞ্চলে সারাদিনে মানুষ প্রায় ৯ গ্রামের মতো লবণ গ্রহণ করে থাকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ডব্লিুওএইচও বলছে, উচ্চ রক্তচাপের প্রভাব কমানোর জন্য লবণ গ্রহণের মাত্রা পাঁচ গ্রামের নিচে থাকতে হবে। লবণের ক্ষেত্রে প্রায় দ্বিগুণ অবস্থায় আছি আমরা। বাংলাদেশে লবণ গ্রহণ বিষয়ে কোনো নীতি এখন পর্যন্ত নেই। এ বিষয়ে নীতি করতে গেলে বিভিন্ন খাতকে সংযুক্ত করতে হবে। এর জন্য উচ্চপর্যায় থেকেও সিদ্ধান্ত আসতে হবে।