শবে মেরাজে ফেরেশতারা যেভাবে প্রিয়নবী সা.-কে অভিবাদন জানিয়েছিলেন

মেরাজের ঘটনা ৬২১ খ্রিস্টাব্দের এক রজনীতে সংঘটিত হয়। নবীজী সা.তখন মক্কায় অবস্থান করছিলেন। কষ্টের বছর হিসেবে পরিচিত ‘আমুল হুজন’ এ যখন নবীজী সা. একের পর এক দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত, তখন আল্লাহ তায়ালা মেরাজের ব্যবস্থা করেন। এটি ছিল নবীজীর জন্য এক মহা সান্ত্বনা এবং উম্মতের জন্য একটি বিশেষ বার্তা।

ফেরেশতাদের অভিবাদনের প্রেক্ষাপট

নবীজী সা.-কে যখন বোরাক নামক বিশেষ বাহনে জেরুজালেমের মসজিদুল আকসায় নিয়ে যাওয়া হয়, তখন ফেরেশতারা তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে অপেক্ষায় ছিলেন। মসজিদুল আকসায় সকল নবী-রাসুল একত্রিত হন। নবীজী সা. তাঁদের ইমামতি করেন। এর মাধ্যমেই তাঁর নবুওয়াতের সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রকাশিত হয়।

এরপর নবীজি সা. ঊর্ধ্বাকাশে আরোহণ করেন। প্রতিটি আসমানে, আসমানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ফেরেশতারা নবীজী সা.কে অভিবাদন জানান। তাঁরা দরজা খুলে স্বাগত জানিয়ে বলেন, মারহাবান বিকা, ইয়া খাইরা খালকিল্লা’ আপনাকে স্বাগতম, হে আল্লাহর সৃষ্টির সেরা।

প্রতিটি আসমানে বিশেষ অভিবাদন

মেরাজের ঘটনা বর্ণনা করে নবীজি সা. বলেন, ওখানে এক ব্যক্তিকে দেখতে পেলাম, যার ডানদিকে রূহের একটি ঝাঁক দেখা গেল, বামদিকেও তেমনি একটি ঝাঁক।

ওই ব্যক্তি ডানদিকে তাকালে হাসেন আর বামদিকে তাকালে ক্রন্দন করেন। তিনি আমাকে দেখে অভ্যর্থনা জানালেন এবং বললেন, মারহাবা হে মহান পুত্র! মারহাবা হে মহান নবী!

নবীজী জিবরীলকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইনি কে? তিনি বললেন, তিনি আদম আ.। তাঁর ডান ও বামদিকে যাদের দেখলেন তারা তাঁর সন্তান। ডানদিকে যারা তারা জান্নাতী; আর বামদিকে যারা, তারা জাহান্নামি। আর তাই তিনি ডানদিকে তাকিয়ে হাসেন এবং বামদিকে তাকিয়ে কাঁদেন।

এরপর জিবরীল আ. নবীজীকে নিয়ে দ্বিতীয় আকাশের পানে ছুটলেন। সেখানেও দ্বার উন্মুক্ত করতে বলা হলে জিজ্ঞাসা করা হল, কে? তিনি জবাব দিলেন, জিবরীল। প্রশ্ন করা হল, আপনার সঙ্গে কে? তিনি উত্তর দিলেন, মুহাম্মাদ। আবার প্রশ্ন হল, তিনি কি আহূত হয়েছেন? তিনি বললেন, হাঁ, তাঁকে আনার জন্য আমি প্রেরিত হয়েছি। দ্বার উন্মুক্ত করা হলে সেখানে দুই খালাত ভাই অর্থাৎ হযরত ঈসা আ. ও ইয়াহইয়া ইবনে যাকারিয়া আ.এর সাথে সাক্ষাৎ হল। তাঁরা উভয়ই নবীজীকে মারহাবা বলে দোয়া করলেন।

এরপর জিবরীল তাঁকে তৃতীয় আকাশে নিয়ে গিয়ে পূর্বের মতো প্রশ্নোত্তর পর্বের পর দ্বার উন্মুক্ত হলে সেখানে হযরত ইউসুফ আ.-এর সাথে সাক্ষাৎ হল। আল্লাহ তাআলা তাঁকে পৃথিবীর রূপ-সৌন্দর্যের অর্ধেকটাই দান করেছিলেন। তিনিও নবীজীকে মারহাবা বলে উষ্ণ অভিবাদন জ্ঞাপন করলেন।

একই পদ্ধতিতে চতুর্থ আকাশে পৌঁছালে সেখানে হযরত ইদরীস আ.এর সাথেও শুভেচ্ছা বিনিময় হল। নবীজী বলেন, আমরা যখন সেখান থেকে সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছিলাম, তখন হযরত মূসা আ. ক্রন্দন করতে লাগলেন। কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, এই যুবক আমার পরে প্রেরিত হয়েছে। তদুপরি তাঁর উম্মত আমার উম্মতের চেয়েও অনেক বেশি জান্নাতে যাবে। একথা ভেবেই আমি কাঁদছি।

সেখান থেকে নবীজীকে সপ্তম আকাশে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে তিনি হযরত ইবরাহিম আ.-কে দেখলেন, তিনি বায়তুল মা‘মুরে ঠেস দিয়ে উপবিষ্ট ছিলেন। বায়তুল মা‘মর সেই স্থান যেখানে প্রতিদিন এমন সত্তর হাজার ফেরেশতা ইবাদত করার জন্য প্রবেশ করে, যাদের পালা এরপর আর কখনও আসে না।

হজরত ইব্রাহীম আ.ও নবীজীকে দেখে অভ্যর্থনা জানালেন। এরপর তিনি নবীজীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, মুহাম্মাদ! আপনার উম্মতকে আমার সালাম বলুন এবং তাদেরকে অবগত করুন যে, জান্নাতের মাটি পবিত্র, এর পানি সুমিষ্ট। জান্নাত হচ্ছে খুব পরিচ্ছন্ন ও সমতল।

এ রাতে নবীজি সা. জাহান্নাম পরিদর্শনে গেলে মালেক নামক জাহান্নামের প্রধান রক্ষী নবীজীকে সালাম ও অভ্যর্থনা জানান।

ফেরেশতাদের অভিবাদনের তাৎপর্য

ফেরেশতারা মহানবী সা.-কে যে সম্মান প্রদর্শন করেন, তা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। এই ঘটনায় আমরা দেখতে পাই, আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের প্রতি ফেরেশতাদের ভালোবাসা ও আনুগত্যের প্রকাশ। এটি ইসলামের মূল শিক্ষা আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের প্রতি আমাদের বিনম্রতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা কীভাবে হওয়া উচিত তা এ ঘটনা থেকে স্পষ্ট হয়।

আমাদের করণীয়

মেরাজের এই মহিমান্বিত ঘটনা আমাদের হৃদয়ে নবীজী সা.-এর প্রতি আরও গভীর ভালোবাসা সঞ্চার করে। আমরা যেন ফেরেশতাদের মতোই নবীজী সা.কে আমাদের জীবনে শ্রদ্ধার সর্বোচ্চ স্থানে রাখি এবং তাঁর সুন্নাহ মেনে চলি।

মেরাজের রাত শুধু এক অলৌকিক ঘটনা নয়, বরং এটি মানবজাতির জন্য এক চিরন্তন দিকনির্দেশনা এবং আল্লাহর অপার কুদরতের সাক্ষ্য। নবীজী সা.-কে ফেরেশতাদের অভিবাদন জানানোর মধ্য দিয়ে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয়তম বান্দার মর্যাদাকে আমাদের সামনে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন।

মেরাজের রাতের স্মৃতি আমাদের ঈমানকে দৃঢ় করে এবং নবীজী সা.এর প্রতি আমাদের আনুগত্যকে আরও গভীর করে। ফেরেশতাদের অভিবাদন একটি বিশেষ দৃষ্টান্ত, যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় নবীজির মর্যাদা কত উচ্চতর। আল্লাহ আমাদের এই ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার তাওফিক দিন। আমিন।

সূত্র: তিরমিজি. হাদিস : ৩১৩১, মুসনাদে আহমাদ ২/৫২৮, মুসলিম, হাদিস : ১৬৫,তিরমিজি, হাদিস : ৩৪৬২

এ জাতীয় আরো সংবাদ

মসজিদের পবিত্রতা রক্ষা করবেন যেভাবে

নূর নিউজ

আল নূর কালচারাল সেন্টারের উদ্যোগে পবিত্র কোরআন বিতরণ

নূর নিউজ

পবিত্র কুরআনে উল্লিখিত ১০টি গাছ

নূর নিউজ