গুলিস্তানস্থ ফুলবাড়িয়া রেলওয়ে জামে মসজিদের খতিব আল্লামা মুহিউদ্দীন রাব্বানী জুমার খুতবায় বলেন, রমজানের শেষ দশকের এতেকাফ সুন্নতে মুআক্কাদা আলাল কেফায়া। অর্থাৎ মহল্লার জামে মসজিদে কোনো রোজাদার মুসলিম এতেকাফ করলে সবার পক্ষ থেকে এ ধরনের সুন্নত আদায় হবে।
তাই এলাকাবাসীর কেউ যদি এতেকাফ না করে তা হলে সুন্নত ছেড়ে দেয়ার কারণে সবার সুন্নত তরকের গুনাহ হবে।
ইতিকাফের মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভি (রহ.) বলেন, ‘মসজিদে ইতিকাফ হচ্ছে হৃদয়ের প্রশান্তি, আত্মার পবিত্রতা ও চিত্তের নিষ্কলুষতা; চিন্তার পরিচ্ছন্নতা ও বিশুদ্ধতা। ফেরেশতাকুলের গুণাবলি অর্জন এবং লাইলাতুল কদরের সৌভাগ্য ও কল্যাণ লাভসহ সব ধরনের ইবাদতের সুযোগ লাভের সর্বোত্তম উপায়। এ জন্য রাসুল (সা.) নিজে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইতিকাফ পালন করেছেন এবং তাঁর বিবিরাসহ সাহাবায়ে কেরামের অনেকেই এই সুন্নতের ওপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমল করেছেন।’ (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা : ২/৪২)
পবিত্র কোরআনে হজরত ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর কথা উল্লেখ করে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি ইবরাহিম ও ইসমাইলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকু-সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র করো।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১২৫)।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অসংখ্য হাদিস ইতিকাফ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। কয়েকটি হাদিস এখানে উল্লেখ করা হলো—
ইবনে উমার (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন।’ (মুসলিম, হাদিস নম্বর ১১৭১)। মদিনায় অবস্থানকালে রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতিবছরই ইতিকাফ পালন করেছেন। শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও রমজানে তিনি ইতিকাফ ছাড়েননি।
আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (সা.) প্রতি রমজানে ১০ দিন ইতিকাফ করতেন, তবে যে বছর তিনি ইন্তেকাল করেন, সে বছর তিনি ২০ দিন ইতিকাফে কাটান।’ (বুখারি, হাদিস : ১৯০৩)।
ইতিকাফ একটি মহৎ ইবাদত। এ ইবাদত স্বেচ্ছায় পালনীয়। ইসলামী শরিয়তে বিনিময় দিয়ে ভাড়া করে ইবাদত করানোর সুযোগ নেই। টাকার বিনিময়ে ইতিকাফ করা ও করানো সম্পূর্ণ নাজায়েজ। এভাবে ইতিকাফ করানোর মাধ্যমে মহল্লাবাসী দায়মুক্ত হয় না। (রদ্দুল মুহতার : ২/৫৯৫, ফাতাওয়া মাহমুদিয়া : ১৭/১৭১)।
রমজান বছরের শ্রেষ্ঠ মাস। এ মাসের সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ দিন হলো শেষ ১০ দিন। কেননা এ দশকেই রয়েছে পবিত্র শবেকদর। বিশেষ হেকমতের কারণে শবেকদরের দিনক্ষণ ঠিক করে দেওয়া হয়নি। এর মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ইবাদতের প্রতি মনোনিবেশ করতে বলা হয়েছে। শবেকদর সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি কোরআন নাজিল করেছি লাইলাতুল কদরে। তুমি কি জান, লাইলাতুল কদর কী? লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।’ (সুরা : কদর, আয়াত : ১-৩)।
আরবি লাইলাতুল কদরের ফারসি হলো শবেকদর। বাংলায় ভাগ্যরজনী। এটি শ্রেষ্ঠতম রাত। এ রাতের ইবাদতের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় শবেকদরে ইবাদত করবে, তার আগের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (মুসলিম, হাদিস : ৭৬০; বুখারি, হাদিস : ২০১৪)
যারা এ রাতের রহমত ও বরকত থেকে বঞ্চিত, তারা সবচেয়ে হতভাগা। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা এমন একটি মাস পেয়েছ, যার মধ্যে এমন একটি রজনী রয়েছে, যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। যে ব্যক্তি এই পুণ্যময় রাতে বঞ্চিত থাকে, সে সমূহ কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত থাকে। সে খুবই হতভাগা, যে এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত থাকে। (মিশকাত, খণ্ড : ১, পৃষ্ঠা-১৭৩; ইবনে মাজাহ : দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১২০)
লাইলাতুল কদরের ফযিলত সম্পর্কে তাফসিরে মাজহারি’র এক হাদিসে বলা হয়, শবে কদরে হজরত জিবরাইল (আ.) ফেরেশতাদের বিরাট এক দল নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং যত নারী-পুরুষ নামাজরত অথবা জিকিরে মশগুল থাকে, তাদের জন্য রহমতের দোয়া করেন। সেইসাথে মিশকাত শরিফে হজরত আবু হোরায়রা (রা.) বর্ণিত এক হাদীসে, নবী করীম (সা.) বলেন, যদি তোমরা কবরকে আলোকময় পেতে চাও তাহলে লাইলাতুল কদরে জাগ্রত থেকে ইবাদত কর। বুখারি শরীফের অন্য আরেকটি হাদীসে বলা হয়, যদি কেউ ঈমানের সঙ্গে সাওয়াব লাভের খাঁটি নিয়তে লাইলাতুল কদর কিয়ামুল্লাইল বা তাহাজ্জুদে অতিবাহিত করে তবে তার পূর্ববর্তী সকল গোনাহ ক্ষমা করা হবে।
লাইলাতুল কদর পাওয়ার জন্য নবীজি (সা.) শেষের ১০ দিন ইতিকাফ করতেন। হজরত আয়িশা (রা.) বলেন, ‘ওফাতের আগ পর্যন্ত প্রত্যেক রমজানের শেষের ১০ দিন রাসুল (সা.) ইতিকাফ করতেন।’ (বুখারি: ২৩২৬, মুসলিম: ১১৭২)। ‘কিন্তু তিনি যে বছর ওফাত পান, সে বছর ২০ দিন ইতিকাফ করেন।’ (বুখারি: ৪৯৯৮)। ‘রাসুল (সা.)–এর ওফাতের পরও তাঁর স্ত্রীগণ ইতিকাফ করতেন।’ (বুখারি: ২০২৬, তিরমিজি: ৭৯০)।
এই রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা প্রথম আসমানে অবতরণ করে বান্দাদের ডেকে ডেকে বলেন, ‘কে আছ অসুস্থ আমার কাছে চাও আমি শেফা দান করব, কে আছ অভাবগ্রস্ত আমার কাছে চাও আমি প্রাচুর্য দান করব, কে আছ বিপদগ্রস্ত আমার কাছে চাও আমি বিপদমুক্ত করে দেব।’
শবেকদর কবে? হাদিস শরিফে এসেছে : ‘তোমরা শেষ দশকের বিজোড় রাতে শবেকদর তালাশ কর।’ (বুখারি, হাদিস : ২০১৭)
নির্দিষ্টভাবে ২৭ রমজানের রাতকে শবেকদর বলা উচিত নয়। কেননা হাদিস শরিফে শেষ দশকের বিজোড় রাতে শবেকদর অন্বেষণ করতে বলা হয়েছে। কোনো কোনো হাদিসে রমজানের শেষ সাত দিনের কথাও এসেছে। হজরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, কয়েকজন সাহাবি রমজানের শেষ সাত রাতে স্বপ্ন মারফত শবেকদর হতে দেখেছেন। সাহাবিদের এ স্বপ্নের কথা জানতে পেরে নবী করিম (সা.) বলেন, ‘আমি দেখছি তোমাদের স্বপ্নগুলো মিলে যাচ্ছে শেষ সাত রাতে। সুতরাং কেউ চাইলে রমজানের শেষ সাত রাতে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করতে পার।’ (বুখারি ও মুসলিম)
মূল কথা হলো, শেষ দশকের সব রাতেই যথাসম্ভব বেশি বেশি ইবাদত করা চাই। বিশেষত শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে রমজানের অন্যান্য রাতের তুলনায় বেশি বেশি ইবাদত, নফল নামাজ, তাসবিহ-তাহলিল ও কোরআন তেলাওয়াত করা চাই। শবেকদরের একটি বিশেষ আমল হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, “আমি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করেছি, ‘হে আল্লাহর রাসুল! যদি আমি শবেকদর পেয়ে যাই, তবে আল্লাহর কাছে কী দোয়া করব?’ রাসুল (সা.) বলেন, ‘এই দোয়া পড়বে—আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুয়্যুন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নি।” অর্থ : হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাকারী এবং আপনি ক্ষমা করা পছন্দ করেন। সুতরাং আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন।
সুতরাং এই রাতের ফজিলত লাভে সচেষ্ট হওয়া আমাদের সবার কর্তব্য। অন্তত এশা ও ফজরের নামাজ যদি জামাতের সঙ্গে আদায় করা যায়, তবু সারা রাত নামাজ পড়ার সমান সওয়াব পাওয়া যাবে। এক হাদিসে এসেছে : ‘যে ব্যক্তি এশা ও ফজর জামাতের সঙ্গে পড়ল সে যেন সারা রাত দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ল।’ (মুসলিম, হাদিস : ৬৫৬)
আল্লাহ আমাদের সকলকে এই পুণ্যবান সময়কে এ’তেকাফের মাধ্যমে কাজে লাগানোর তৌফিক দান করুন।