বিশেষ প্রতিবদেক:
কুমিল্লায় একটি পূজামণ্ডপে কোরআন অবমাননার ঘটনার জের ধরে কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী, কিশোরগঞ্জ, চাঁদপুর ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলা, পুলিশের সাথে সংঘর্ষের ঘটনায় বিভিন্ন জেলায় একাধিক মামলা হয়েছে। এসব মামলায় কারো কারো নাম উল্লেখ করা হয়েছে। একইসাথে অজ্ঞাতনামা হিসেবে কয়েক হাজার মানুষকে আসামি করা হয়েছে। এরই মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে শতাধিক। গ্রেফতার আতঙ্গে আছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ।
বুধবার থেকে শুরু হওয়া এসব সহিংসতায় রোববার পর্যন্ত ছয়জনের প্রাণ গেছে। আহত হয়েছেন কয়েক শ’ মানুষ।
ঢাকার সহিংসতার ঘটনায় আসামি ৪০০০
শুক্রবার ঢাকার কাকরাইলে পুলিশের সাথে সংঘর্ষের ঘটনায় মামলা হয়েছে রমনা ও পল্টন থানায়। এসব মামলায় ২১ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়েছে চার হাজার জনকে।
শুক্রবার জুমার নামাজের পর কয়েক শ’ মানুষ বায়তুল মোকাররম থেকে মিছিল বের করে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। পুলিশ লাঠিচার্জ, টিয়ার সেল ও শটগানের গুলি ছুঁড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে। এসব মামলায় সরকারি কাজে বাধা ও পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগ আনা হয়েছে।
রমনা থানার মামলায় ১০ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ১৫ শ’ মানুষকে আসামি করা হয়েছে।
রমনা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মনিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, শুক্রবার সংঘর্ষের সময় যে ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, মামলায় তাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
সেদিনের ঘটনায় পল্টন থানায় দায়ের করা মামলায় ১১ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা দুই থেকে আড়াই হাজার মানুষকে আসামি করা হয়েছে।
পল্টন থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সালাউদ্দিন মিয়া বলেন, শুক্রবার দুপুরে নামাজের পর সংঘর্ষের সময় এদের মধ্যে ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। বাকি পাঁচজন পলাতক রয়েছে। তাদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা করা হচ্ছে।
চট্টগ্রামে আসামি ৫০০, গ্রেফতার ৮৪
চট্টগ্রামের পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনায় ৮৪ জনের নাম উল্লেখ আর অজ্ঞাতনামা ৫০০ ব্যক্তিকে আসামি করে শনিবার মামলা করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের জেএম সেন হলে শুক্রবার ওই হামলার ঘটনা ঘটে। কুমিল্লায় কোরআন অবমাননার অভিযোগ এনে এর প্রতিবাদে চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে জুমার নামাজ শেষে মিছিল নিয়ে যাওয়ার সময় জেএম সেন পূজামণ্ডপে হামলার করা হয়েছিল।
কোতোয়ালি থানার ওসি নেজামউদ্দিন জানিয়েছেন, সেখানকার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ, স্থিরচিত্র দেখে সরাসরি হামলার সাথে জড়িতদের শনাক্ত করে গ্রেফতার করা হয়েছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত আনা, পুলিশের ওপর হামলা ও বিশেষ ক্ষমতা আইনের ধারায় এসব মামলা করা হয়েছে।
কুমিল্লায় গ্রেফতার ৪০
কুমিল্লায় সহিংসতার ঘটনায় পাঁচটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত ৪০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
কুমিল্লা কোতোয়ালি থানার ওসি আনোয়ারুল আজিম জানিয়েছেন, কোরআন অবমাননা ও প্রতিমা ভাঙচুরের মামলায় পুলিশ চারটি মামলা করেছে। র্যাবের পক্ষ থেকে আরো একটি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে মামলায়। এসব মামলায় মোট ৪০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এসব মামলায় অজ্ঞাতনামা শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।
যে ব্যক্তির মোবাইল ফোন দিয়ে মণ্ডপে কোরআন রাখার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করা হয়েছিল, তাকেও গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ওই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পরই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে আসামি ২০০০
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে বুধবারের সহিংসতার ঘটনায় চারটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় দুই হাজারের বেশি ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।
হাজীগঞ্জ থানায় হামলায় ও পুলিশ আহতের ঘটনায় দু’টি মামলা হয়েছে। এছাড়া দু’টি মন্দিরের কর্তৃপক্ষ বাদী হয়ে দু’টি মামলা করেছেন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো: সোহেল মাহমুদ জানিয়েছেন, বড় মিছিল নিয়ে থানায় ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় অজ্ঞাতনামা দুই হাজার ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা হয়েছে। এছাড়া মন্দির কর্তৃপক্ষও দু’টি মামলা করেছে। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত ১৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
কিশোরগঞ্জে আসামি ৩৫
শুক্রবার বিকেলে কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার গুন্ধর ইউনিয়নে কাদিম মাইজহাটি গ্রামের একটি মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুর হয়। ওই ঘটনায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, মূর্তি ভাঙচুর, চুরি ইত্যাদি অভিযোগে একটি মামলা হয়েছে।
করিমগঞ্জ থানার ওসি মমিনুল ইসলাম জানিয়েছেন, মামলায় নয়জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, অজ্ঞাতনামা আসামি রয়েছে ৩০-৩৫ জন। এদের মধ্যে চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
ফেনীতে দুই মামলায় আসামি ৪০০
ফেনী থানার ওসি মো: মনির হোসেন বলছেন, শুক্রবারের সংঘর্ষের ঘটনায় দু’টি মামলা হচ্ছে। এসব মামলায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, পুলিশের ওপর হামলা, সরকারি কাজে বাধা দান, ইত্যাদি অভিযোগ আনা হয়েছে।
প্রথম মামলায় অজ্ঞাতনামা ২৫০ ব্যক্তিকে, দ্বিতীয় মামলায় ১৫০ ব্যক্তিকে আসামি করা হচ্ছে। তবে এখনো কোনো গ্রেফতার নেই।
শুক্রবার কেন্দ্রীয় বড় জামে মসজিদের সামনে থেকে আছরের নামাজের পর বিক্ষোভ শুরু হয়। অন্যদিকে পূজামণ্ডপে হামলা ও ভাঙচুরের প্রতিবাদে সেখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন অবস্থান নেন। একপর্যায়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে পুলিশ লাঠিচার্জ ও টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
নোয়াখালীতে ৪ মামলায় আসামি ৩০০০
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌমুহনীতে শুক্রবার হামলার ঘটনায় ইসকন মন্দির কর্তৃপক্ষ একটি হত্যা মামলা করেছে। একইসাথে মন্দিরে হামলা, ভাঙচুরের অভিযোগও আনা হয়েছে। সেখানে হামলায় দু’জন নিহত হয়েছেন।
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহ ইমরান জানিয়ছেন, হামলার ঘটনায় ইসকন কর্তৃপক্ষ একটি মামলা করেছে। সেখানে কয়েকজন এজাহারে নাম রয়েছে। এছাড়া অজ্ঞাত ২০০-২৫০ ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।
এর বাইরে পুলিশ হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি অভিযোগ তিনটি মামলা করেছে। সেসব মামলায় ২০০ ব্যক্তির নাম উল্লেখ আর দুই থেকে আড়াই হাজার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।
শাহ ইমরান জানাচ্ছেন, যেসব মন্দিরে হামলা হয়েছে, পুলিশ সবাইকে মামলা করতে অনুরোধ করেছে। কিন্তু অনেক মন্দির কর্তৃপক্ষ মামলা করতে রাজি হচ্ছে না।
সূত্র : বিবিসি