সূরা যিলযাল পবিত্র কোরআনের ৯৯ নম্বর সূরা। এর আয়াত সংখ্যা আট। সূরাটি মদিনায় অবতীর্ণ। সূরা যিলযাল সম্পর্কে হজরত আনাস ও ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূরা যিলযালকে কোরআনের অর্ধেক বলেছেন, সূরা ইখলাসকে কোরআনের এক তৃতীয়াংশ এবং সূরা কাফিরূনকে কোরআনের এক চতুর্থাংশ বলেছেন। (মাযহারী, তাফসিরে মাআরেফুল কোরআন, ৮/৮৪৩)
সূরা যিলযাল
اِذَا زُلۡزِلَتِ الۡاَرۡضُ زِلۡزَالَہَا ۙ ١ وَاَخۡرَجَتِ الۡاَرۡضُ اَثۡقَالَہَا ۙ ٢ وَقَالَ الۡاِنۡسَانُ مَا لَہَا ۚ ٣ یَوۡمَئِذٍ تُحَدِّثُ اَخۡبَارَہَا ۙ ٤ بِاَنَّ رَبَّکَ اَوۡحٰی لَہَا ؕ ٥ یَوۡمَئِذٍ یَّصۡدُرُ النَّاسُ اَشۡتَاتًا ۬ۙ لِّیُرَوۡا اَعۡمَالَہُمۡ ؕ ٦ فَمَنۡ یَّعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّۃٍ خَیۡرًا یَّرَہٗ ؕ ٧ وَمَنۡ یَّعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّۃٍ شَرًّا یَّرَہٗ ٪
সূরা যিলযালের অর্থ
যখন পৃথিবীকে আপন কম্পনে ঝাঁকিয়ে দেওয়া হবে। এবং ভূমি তার ভার বের করে দেবে, এবং মানুষ বলবে, তার কী হল?,সে দিন পৃথিবী তার যাবতীয় সংবাদ জানিয়ে দেবে। কেননা তোমার প্রতিপালক তাকে সেই আদেশই করবেন। সে দিন মানুষ বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে প্রত্যাবর্তন করবে, কারণ তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম দেখানো হবে। সুতরাং কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করে থাকলে সে তা দেখতে পাবে। এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করে থাকলে তাও দেখতে পাবে।
সূরা যিলযালে কিয়ামত দিবসের বর্ণনা
এই সূরার প্রথম আয়াতে জানানো হয়েছে, কিয়ামতের আগে যখন শিঙ্কায় ফুৎকার দেওয়া হবে তখন ভূমিকম্পের কারণে পুরো পৃথিবী কেঁপে উঠবে। আর সব কিছু চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। এই অবস্থা তখন হবে, যখন শিঙ্গায় প্রথমবার ফুৎকার করা হবে।
পরের আয়াতে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় ফুঁৎকারের পরে মাটির নিচে যত মানুষ দাফন আছে, তাদেরকে এবং খনিজ পদার্থ ও গুপ্ত ধনগুলোকে জমিন বাইরে বের করে এনে ফেলে দেবে এবং যাবতীয় মৃতকে বের করে হাশরের মাঠের দিকে চালিত করবে।
কোনো কোনো মুফাসসির এর মতে, সোনা, রূপা, হীরা, মণি-মাণিক্য এবং অন্যান্য যেসব মূল্যবান সম্পদ ভূ-গর্ভে সঞ্চিত রয়েছে সেগুলোর বিশাল বিশাল স্তুপও সেদিন জমিন উগলে দেবে।
হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘পৃথিবী তার কলিজার টুকরা বিশালাকার স্বর্ণ খণ্ডের আকারে উদগীরণ করে দেবে। তখন যে ব্যক্তি ধনসম্পদের জন্যে কাউকে হত্যা করেছিল, সে তা দেখে বলবে, এর জন্যেই কি আমি এতবড় অপরাধ করেছিলাম? যে ব্যক্তি অর্থের কারণে আত্মীয়দের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছিল, সে বলবে, এর জন্যেই কি আমি এ কাণ্ড করেছিলাম? চুরির কারণে যার হাত কাটা হয়েছিল, সে বলবে, এর জন্যেই কি আমি নিজের হাত হারিয়েছিলাম? অতঃপর কেউ এসব স্বর্ণখণ্ডের প্রতি ভ্ৰক্ষেপও করবে না। (মুসলিম, হাদিস, ১০১৩)
পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে, ফুৎকারের পর মানুষ পুনরায় জীবন লাভ করে চেতনা ফিরে পাবার সাথে সাথেই প্রত্যেক ব্যক্তির প্রথম প্রতিক্রিয়া এমন হবে যে, এসব কি হচ্ছে? এটা যে হাশরের দিন একথা সে পরে বুঝতে পারবে।
এর পরবর্তী আয়াত তিলাওয়াত করে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা জান, পৃথিবীর বৃত্তান্ত কি?’ সাহাবীগণ (রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম) বললেন, আল্লাহ এবং তার রসূলই ভাল জানেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তার বৃত্তান্ত এই যে, নারী অথবা পুরুষ এ মাটির উপর যা কিছু করছে এই মাটি তার সাক্ষী দেবে। আর বলবে, অমুক অমুক ব্যক্তি অমুক অমুক দিনে অমুক অমুক কর্ম করেছে। (তিরমিজি, মুসনাদে আহমদ ২/৩৭৪)
আর জমিন মানুষের সব কর্মের কথা বলে দিবে কারণ, মাটিকে কথা বলার শক্তি আল্লাহই সেদিন দান করবেন। তাই এটা কোনো আশ্চর্যজনক কথা নয়। যেমন সেদিন মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আল্লাহ বাকশক্তি দান করবেন, ঠিক মাটিও আল্লাহর হুকুমে কথা বলবে। (জড়পদার্থের কথা বা শব্দ ধরে রাখা এবং প্রয়োজনে তা শুনিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা তো বিজ্ঞানও প্রমাণ করেছে। অতএব সৃষ্টিকর্তার আদেশে মাটির কথা বলার ব্যাপারটা কোন আশ্চর্যের নয়।
আর সেদিন মানুষকে তাদের আমল দেখানো হবে। প্রত্যেকে দুনিয়ায় কি কাজ করে এসেছে তা তাকে বলা হবে। কোরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে একথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, কাফের মুমিন, সৎকর্মশীল ও ফাসেক, আল্লাহর হুকুমের অনুগত ও নাফরমান সবাইকে অবশ্যই তাদের আমলনামা দেয়া হবে। (সূরা আল-হাক্কার ১৯ ও ২৫, সূরা আল-ইনশিকাকের ৭–১০ নম্বর আয়াত)
মুমিন ব্যক্তি যতবড় গোনাহগারই হোক ঈমানের সাথে সম্পাদিত অণু পরিমাণ নেক আমল থাকলে তাকে তার প্রতিদান দেওয়া হবে। এবং তাকে জাহান্নাম থেকে বের করে নেওয়া হবে।
আর একইভাবে কারো অসৎ কাজ থাকলে তারও হিসাব নেওয়া হবে। এজন্য কোনো ছোট ও নগণ্য অসৎকাজও করা উচিত নয়; কারণ এই ধরনের অনেকগুলো ছোট গুনাহ একত্র হয়ে একটি বিরাট গুনাহের স্তুপ জমে উঠতে পারে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচো-তা এক টুকরা খেজুর দান করার বা একটি ভালো কথা বলার বিনিময়েই হোক না কেন’। (বুখারি, হাদিস, ৬৫৪০)
অপর এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন, ‘কোন সৎকাজকেও সামান্য ও নগণ্য মনে করো না, যদিও তা কোনো পানি পার করতে ইচ্ছুক ব্যক্তির পাত্রে এক মগ পানি ঢেলে দেওয়াই হয় অথবা তোমার কোনো ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাত করাই হয়।’ (মুসনাদে আহমাদ, ৫/৬৩)