সেই রাতে কী ঘটেছিল পটিয়ায়, প্রত্যক্ষদর্শীর শ্বাসরুদ্ধকর লোমহর্ষক বর্ণনা!

(লিখেছেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী উলুমুল হাদিসের ছাত্র যিয়াদ বিন সাঈদ)

হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর খানদানের নগন্য অংশীদার হিসেবে পটিয়ায় যাওয়ার পর সবচেয়ে বেশী শ্রদ্ধা এবং আত্মজ মুহাব্বত অনুভব করেছি যে মানুষটিকে ঘিরে, তিনি জামিয়ার বর্তমান শাইখুল হাদীস হাফেজ আহমাদুল্লাহ সাহেব দা.বা.। হাফেজ সাহেব হুজুর হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর গুরুত্বপূর্ণ খলীফাদের একজন। খলীফাদের সবাইকেই প্রায় দেখেছি যে, যখনই তারা শুনতে পেয়েছেন আমরা হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর নসলের কেউ, কী এক বিস্ময়কর মুহাব্বতে তারা আমাদেরকে আগলে নিয়েছেন, তা ভাবনাতীত।

অন্যদিকে যুগসচেতনতা, মাদরাসার উন্নয়নমুখী চিন্তা এবং অসামান্য যোগ্যতার অধিকারী হিসেবে যে মানুষটিকে দেখে বিস্মিত হয়েছি, তিনি জামিয়ার বর্তমান মুহতামিম মাওলানা ওবায়দুল্লাহ হামযাহ হাফিযাহুল্লাহ। ইন্টারন্যাশনালি জামিয়াকে পৃথিবীর নানাদিকে তুলে ধরা, জামিয়ার ছাত্রদের জন্য উচ্চশিক্ষার দ্বার উন্মোচন করে দিয়ে মিডলইস্টের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সচেষ্ট হওয়াসহ বহুমুখী কার্যক্রমের ফিরিস্তি দেখে তার প্রতিই শুদ্ধতা মুগ্ধতা কাজ করেছে, তা না, জামিয়াকেও আলাদাভাবে অনুভব করার রসদ পেয়েছি।

হ্যাঁ, এটা ঠিক উনাদের কেউই আমার সরাসরি উস্তায নন। এ বছরই আমি সেখানে গিয়েছি। উলূমুল হাদীস বিভাগে ভর্তি হয়েছি। সে হিসেবে জামিয়া পটিয়ায় সরাসরি উস্তায আমার একজনই, আমাদের উলূমুল হাদীসের মুহতারাম মুশরিফ, উস্তায ত্বহা দানিশ হাফিযাহুল্লাহ।

কিন্তু অতুলনীয় দুটি সত্তাকে আল্লাহ কোন সে কল্যাণের লক্ষ্যে দু মেরুতে নিয়ে আমাদের মত নিরুপায় ছাত্রদেরকে অনেক বড় একটি পরীক্ষার সম্মুখীন করে দিলেন, এ পরীক্ষায় সত্যিই আমরা উত্তীর্ণ হতে পারবো কি-না, এসবের কিছুই জানিনা। নিশ্চয়ই এই ইখতিলাফ একদিন রহমত হয়ে প্রতিফলিত হবে। কিন্তু নিছক অন্তর্গত কোন্দলের কারণে এরই মধ্য দিয়ে কওমী মাদরাসা যে ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়ে গেলো, যেভাবে বিলীন হয়ে গেল মর্যাদার ইতিহাস, তা কি সহসা স্বাভাবিক হবে?

বড়দের মতের ভিন্নতা এবং পারস্পরিক বোঝাপড়াকেন্দ্রিক অভিমানকে পুঁজি করে যেভাবে একটি সার্থান্বেষী চক্র কওমি মাদরাসার বড় ক্ষতি করে ফেলার সুযোগ পেয়ে গেলো, বেয়াদবির অসুস্থ সংস্কৃতি তৈরি করে দিয়ে তারা কেটে পড়লো এবং অন্যদিকে প্রয়োজনে প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে হলেও প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার প্রবণতা তৈরি হলো, এসবের ধকল সহ্য করার ক্ষমতা কি আছে আমাদের?

আদাবুল ইখতিলাফকে ন্যুনতম তোয়াক্কা না করে যেভাবে আমাদের ভেতর জায়গা করে নিলো বাজে একটা সংস্কৃতি, যেখানে প্রতিপক্ষকে দমন করতে গিয়ে চলতে থাকলো একমনে মিথ্যাচার, নাম বিকৃতি, অপবাদ, গালাগাল এবং কারো কৃতিত্বকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়ার মতো হীন সব কার্যকলাপ। আসলে, ছোটমুখে বড় কথা বড্ড বেমানান, কিন্তু এটাই প্রকৃত সত্য যে, ইখতিলাফ চরমে পৌছে যাওয়ার ফলে তাঁদের ইখতেলাফ যৌক্তিক হলেও এর খারাপ পরিণতিগুলোর দিকে সামান্যতম ভ্রুক্ষেপ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন না।যেভাবেই হোক, প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করে সফলতা নিজের ঘরে তুলে আনতে অযাচিত এবং কওমি মাদরাসার স্বকীয়তা পরিপন্থী সকল কার্যক্রমকে পরোক্ষ বৈধতা দিয়ে যাচ্ছেন।

ভেতরগত অনৈক্য কিংবা মতের ভিন্নতা তো থাকবে, সেটা সুস্থ ও স্বাভাবিক পন্থায় নিষ্পত্তি করতে হবে, এ ধরণের মেজাজ অন্তত তরুণ প্রজন্ম যেন ধরে রাখে, আইন যেন নিজের হাতে তুলে না নেয়, এবং পরবর্তী সময়ে বাস্তব জীবনেও এ ধরণের পরীক্ষার মুখোমুখি হলে প্রতিপক্ষকে দমাতে কোনো অসুস্থ প্রক্রিয়ায় যাওয়ার মত আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত যেন কেউ না নেয়, সে চিন্তায় আমি জামিয়া পটিয়ায় স্বচক্ষে দেখা ঘৃণ্য একটি ইতিহাসের ‘গন্ধ’ চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়ার দুঃসাহস করতে চাই। যদিও এ আমার দুর্ভাগ্য যে কওমি মাদরাসার অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া এই অনাকাঙ্ক্ষিত এবং ঘৃণাভরে ছুঁড়ে ফেলার মতো একটি স্মৃতি আমাকে বয়ে বেড়াতে হবে বহুকাল।

আদতে এটা কোনো ফলাফল না, হক-বাতিলের নির্ণয় না, শুরা-সিদ্ধান্তের গভীর কোনো বিশ্লেষণও না, প্রত্যক্ষদর্শীর জবানিতে কওমি মাদরাসার অভ্যন্তরে ছাত্রদের হাতে উগড়ে ওঠা আন্দোলন-সংস্কৃতির একটি নির্মোহ ধারাবর্ণনা কেবল।
এমন রাত আর না আসুক এ জীবনে, হে পরওয়ারদিগার

উলূমুল হাদীসের সবাই দারুল মুতালাআয় বসে তা’ইইনুর রুওয়াতের তামরীন করছি৷ রাত সাড়ে এগারোটা তখন। প্রতি রাতেই অন্তত আড়াইটা পর্যন্ত জেগে থাকতে হচ্ছে সবাইকে৷ সেমিস্টার শেষ হয়ে যাচ্ছে, মানহাজের অনেক তামরীন, অনেক মুতালাআ এখনও বাকি। বিপর্যস্ত এ সময়ে দ্বিতীয় বর্ষের ফরহাদ ভাই হঠাত এসে অনেকটা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতেই জানালেন, জানেন কিনা, গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, ঠিক বারোটায় পুরো মাদরাসায় সবাই তাকবির দিয়ে উঠবে? মাদরাসার আভ্যন্তরীণ জটিলতা, আসাতিযায়ে কেরামের মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং ইত্যাদি সম্পর্কে আগেও আমরা ওয়াকিবহাল ছিলাম। কিন্তু এটা আন্দোলন বা অপ্রতিরোধ্য কোনো ঘটনায় গড়াবে, সেটা অসম্ভব ভেবে আমরা হাসতে হাসতেই উড়িয়ে দিলাম। তবুও ফরহাদ ভাই অন্তত উলূমুল হাদিসে এসে কেউ যেন বিশৃঙ্খলা করতে না পারে, সে ব্যাপারে সোচ্চার থাকার কথা বললেন।

এগারোটা পঞ্চান্ন মিনিটে সত্যি সত্যিই আমাদের ধারণাকে অসত্য প্রমাণিত করে চারোদিক থেকে হঠাৎ ‘হই হই’ শব্দে পুরো মাদরাসা কেঁপে উঠলো। বারান্দায় এসে মাঠের দিকে নজর দিতেই দেখলাম ‘মুখোশ’ পরা বহুসংখ্যক ছাত্র চারিদিক থেকে মাঠে এসে জড়ো হচ্ছে, গামছা-রুমাল দিয়ে বাঁধা তাদের অধিকাংশের মুখ, চোখ দুটি দেখা যাচ্ছে শুধু৷ পাইপ, কাঠ, বাঁশ এবং রডহাতে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে সবাই। সেইসাথে হুলস্থুল ভাঙচুরের আওয়াজ। থাই গ্লাসগুলো সব ঝনঝন করে ভেঙে পড়ছে। স্টিলের দরজা-জানালায় বিরামহীন আঘাতের শব্দ অস্বাভাবিক ভয়াবহ একটি পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। সেইসাথে সমস্বরে চিৎকারের প্রকম্পন তো আকাশ-বাতাস ছাপিয়ে যাচ্ছেই৷

নিশ্চিত হলাম, বারোটার মধ্যেই মাত্র পাঁচ মিনিটের মাথায় আন্দোলনকারীদের দখলে চলে এসেছে পুরো মাদরাসা। মসজিদের সেন্ট্রাল মাইক তারা আয়ত্ত্বে নিয়ে নিয়েছে। এখান থেকে মুহূর্মুহু তাকবির, স্লোগান এবং আন্দোলনের স্বপক্ষে বক্তৃতা শুরু হয়ে গেছে। পুরো মাদরাসার সব লাইট নিভিয়ে দেয়া হয়েছে৷ যেসব উস্তাযকে নিয়ে তাদের শঙ্কা, তাদের রুমে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে, যেন তারা বাধাপ্রদান না করতে পারে।

প্রথম ধাপে তারা সফল হয়ে যাওয়ার পর, দ্বিতীয় ধাপে সকল ছাত্রকে মাঠে নিয়ে আসার কাজটি করতে পুরো মাদরাসার প্রতিটি ভবনে অভিযান শুরু করেছে। ‘মুখোশ’ পরে রড-পাইপ হাতে প্রতিটি রুমে গিয়েছে তাদের কথিত ‘টহলবাহিনী’, ভালোয় ভালোয় বের হয়ে গেলে কিছু বলছেনা, দেরি করলে দরজা জানালা ভেঙে মারধর করে বের করে আনছে।

নিরীহ গোছের এই ‘আমরা’ তখনই পড়েছি বিপদে। আন্দোলন যখন শুরু হয়েছে, আমাদের উলূমুল হাদিস বিভাগে চার-পাঁচজন মুখোশধারী এসে আমাদেরকে নিয়ে যেতে চাইলে, অসম্মতি জানিয়ে আমরা তাদেরকে বাধা দিই। যেহেতু এই আন্দোলনের সাথে ‘সংহতি’ জানানোর কোনো অবকাশই ছিলোনা। কিন্তু এই বাধাপ্রদান আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।

ওরা আমাদের প্রথম বর্ষের দুই ভাইকে প্রচণ্ড মারধর করে, মাথায় আঘাত করে, অনেক বেশি রক্তক্ষরণ হয়। আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ায় ক্ষোভ তৈরি হয়, তখন ওদের চারজনের একজনকে আটকে উলূমুল হাদিসে নিয়ে আসা হয়। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ছেড়ে দেয়া হলেও একটু পর আমরা মসজিদের মাইকে শুনতে পাই, চিৎকার করে বলা হচ্ছে— উলূমুল হাদিসের ছাত্ররা শুনে রাখো, আমাদের টহল বাহিনী তোমাদের ওখানে যাবে, তোমাদেরকে দেখে নেবে, প্রয়োজনে তোমাদের শরীর থেকে ‘কল্লা’ আলাদা করে ফেলা হবে। (রেকর্ড সংরক্ষিত আছে)

মাইকে এই ঘোষণার পরই আমরা যার যার রুমে ঢুকে যাই। এদিকে প্রচণ্ড ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে নীচ থেকে উলূমুল হাদিস এবং উস্তায ত্বহা দানিশ হাফিযাহুল্লাহকে লক্ষ করে। উস্তায যেহেতু এই অসুস্থ আন্দোলনকে কোনোভাবেই সমর্থন করতে পারেননি। তাই আন্দোলনকারীরা তার উপর ভীষণভাবে ক্রুদ্ধ। কিন্তু আমাদের উপস্থিতির কারণে হুজুরের রুমে তালা ঝোলানো সম্ভব হয়নি। আন্দোলনের সূচনাতে হুজুর যথাসম্ভব দমিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছেন। অন্তত উলূমুল হাদিসে এসে কেউ যেন বিশৃঙ্খলা করতে না পারে, সে প্রচেষ্টাটি করেছেন। কিন্তু পরিকল্পিত আন্দোলনের মুখে উস্তাযের কোনো প্রচেষ্টাই আর দীর্ঘ হয়নি।

মাইকে হুমকি দেয়ার দশ মিনিটের মাথায় ‘টহল বাহিনী’ চলে আসে উলূমুল হাদিসে। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি খুব। এসময়ে আসলে আমাদের আর কিছু করারও থাকেনা। আল্লাহর দিকে মুতাওয়াজ্জু হতে চেষ্টা করি। টহল বাহিনী এসেই জানালাটা ভেঙে ফেলে৷ ঝনঝন করে ভেঙে পড়ে থাইগ্লাস৷ এরপর বের হয়ে আসার জন্য অকথ্য গালাগাল আর উপর্যুপরি আঘাত চলতে থাকে। দরজা ভেঙে ফেলার আগেই আমরা ভীতচিত্তে তাদের আন্দোলনের সাথে সংহতির কথা আওয়াজ করে জানান দিই।

সেইফ এগজিটের কথা বললে ওরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে৷ আমরা দরজা খুলে দিই৷ যথারীতি ‘মুখোশ’ পরিহিত ৬/৭ জনের একটি দল চিৎকার করতে থাকে। ওদের হিংস্র মনোভাব এবং হাতে বাঁশ-রড দেখে পায়ে পড়ে মুক্তি চাওয়াকেও একসময় মনে হতে থাকে একমাত্র উপায়৷ কিন্তু কোন অপরাধে ওদের কাছে সকল গায়রতকে জলাঞ্জলি দেব?

যত্রতত্র আঘাত, মারধর এবং অপমানের লজ্জায় লাল হয়ে হাত উঠিয়ে আত্মসমর্পনের ভঙ্গিতে আমরা রুম থেকে বেরিয়ে সরাসরি মাঠে গিয়ে অবস্থান নিই। আমাদেরকে লাঠি দিয়ে আঘাত না করলেও পঞ্চম তলায় দেখতে পাই একটি রুমে কিছু ছাত্র বেরিয়ে আসতে অস্বীকৃতি জানালে তাদেরকে নির্মমভাবে মারধর করে রুম থেকে বের করা হচ্ছে।

আন্দোলনে অসমর্থন জানানোর আক্রোশে ‘টহল বাহিনী’ আমাদের কামরাগুলো ভাঙচুর করে উস্তায ত্বহা দানিশ হাফিযাহুল্লাহর রুমেও আক্রমণ করে। ভেতরে উস্তায আছেন জেনেও উপর্যুপরি ভাংচুর চালায়। হুজুরের ওয়াকার এবং গাম্ভীর্যের কারণে সরাসরি কিছু বলতে না পারলেও ভাঙচুর করে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়াটা সরাসরি আঘাতের চেয়ে কম কিছু না।

কিন্তু আমাদের একমাত্র উস্তাযের সাথে বেয়াদবির ধৃষ্ঠতা তারা অবলীলায় এখানে প্রদর্শন করে গেলেও নিজ উস্তাযকে নিরাপত্তা দিতে পারিনি বলে যেভাবে অপরাধবোধে বিদ্ধ হয়েছি, সেটা এখনও রীতিমত পীড়া দিচ্ছে। আসলে এই নির্বোধ ছাত্ররা কি-ইবা আর অনুভব করবে জামিয়ার প্রতি উস্তাযের দরদ, কতটুকুইবা আর বুঝতে সক্ষম হবে আসাতিযায়ে কেরামের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে উস্তাযের প্রতিটি নকল-হরকত। জামিয়ার মর্যাদা ধূলোয় মিশে যাচ্ছে বলে যে মানুষটি সিজদায় পড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেঁদে চলেছেন অবিরাম, তার সাথে এই ঔদ্ধত্য?

উস্তাযকে রেখেই প্রাণভয়ে নিচে নেমে আসার সময় দেখতে পাই তৃতীয় তলায় মাদরাসার প্রধান দারুল ইকামার রুমও ভেঙে তছনছ করে ফেলা হয়েছে। স্বভাবত উনি কড়া স্বভাবের ছিলেন। দারুল ইকামার নেযাম বাস্তবায়নে সবসময়ই মারমুখী অবস্থানে থাকতেন। ছাত্রদের এই জমে থাকা রাগের অসুস্থ বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে হয়তো।

ততক্ষণে আমরা মাঠের একদম মাঝখানে গিয়ে অবস্থান নিয়ে নিয়েছি। মাঠের চারপাশ থেকে টহল বাহিনী ঘিরে রেখেছে ফিল্ড। একবার ওয়াশরুমে যেতে চেয়ে প্রহরায় নিয়োজিত এক ভাইকে অনুরোধ করলে, সে নির্লজ্জভাবে আমাকে বলে, ‘মাঠে কি জায়গা কম আছে? গাছের গোড়ায় করে দেন’। এদিকে মাঠ থেকেই তখন দেখা যায়, ইফতার ছাত্ররা বেরিয়ে আসতে দেরি করছে বলে সেখানে প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ করেছে মুখোশ পরা ‘টহল বাহিনী’।

দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্ররা ঘুমিয়ে পড়েছিল, ওদেরকেও মারধর করে বের করা হয়েছে শুনেছি।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা যায়, ডেকোরেটরের বড় মাইকগুলো মাঠে এনে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। কোত্থেকে এলো, কে জানে! তখনও কিছু কিছু সিসি ক্যামেরা মাদরাসার অভ্যন্তরে অক্ষুণ্ণ ছিল। আন্দোলনকারীরা খুঁজে খুঁজে সেসব সিসিক্যামেরা ভাঙচুর করে। প্রতিটি সিসি ক্যামেরা ভাঙার সাথে সাথে মাঠ জুড়ে বুনো উল্লাসের আওয়াজ শোনা যায়। আমরাও তাদের সাথে গলা মিলিয়ে চিৎকার করতে থাকি।
স্লোগানের ভাষা, বক্তব্যরত আন্দোলনকারীদের শব্দচয়ন শুনে রীতিমতো চমকে উঠি। ‘একটা একটা দালাল ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর’, ‘এক দফা এক দাবী, ওবায়দুল্লাহ কবে যাবি’ ‘দালালী আর করিস না, পিঠের চামড়া থাকবেনা’, ‘হই হই রই রই, ওবায়দুল্লাহ গেলি কই’ ইত্যাদি স্লোগান রাতভর চলমান থাকে। অন্যদিকে ওবায়দুল্লাহ হামযা সাহেবের পক্ষে থাকা উস্তায এবং খাদেমদের নাম ধরে ধরে হুমকি-ধমকি প্রকাশ্যেই মাইকে উচ্চারিত হতে থাকে।

সালিম মাহদী নামের এক উস্তাযকে হুমকি দিতে গিয়ে বলা হয়, মাঠে এনে সবার সামনে তোকে উলঙ্গ করে ছেড়ে দেয়া হবে।

বক্তব্যের ফাঁকে পাঠ করা হয় কথিত তেরো দফা দাবি। ওবায়দুল্লাহ হামযাহ সাহেবকে বহিষ্কার, মোবাইল চালানোর কারণে বহিষ্কৃত ছাত্রদেরকে ফিরিয়ে আনা, মাদরাসার অভ্যন্তরে সিলিন্ডার ব্যবহার করে পাকশাক করার অনুমতি এবং শশমাহী ইমতেহান বাতিল ঘোষণাসহ এমন সব দাবি সেখানে উত্থাপিত হতে থাকে, যেন-বা ওরা চাইছে ছাত্রদের আদেশ-নিষেধ মোতাবেক আজ থেকে চলবে মাদরাসা।

বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তাদের সাইবার-কর্মীদের তৎপরতাও লক্ষ করি। সোশ্যাল মিডিয়ার কোথাও এই আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে পোস্ট করা হলে পোস্টদাতার নাম ম্যানশন করে ঘোষণা হয়, ‘মুজাদ্দিদ টিমের ভাইয়েরা, অমুক নামের আইডি থেকে আমাদের ব্যাপারে এই এই লেখা হয়েছে, আপনারা সম্মিলিতভাবে সেখানে রিপোর্ট করুন’। বলে রাখা ভালো, পরবর্তীতে জানতে পারি ‘মু জা দ্দি দ’ এই আন্দোলন পরিচালনার একটি অনলাইন মাধ্যমে। ফেসবুকে এ নামের আইডি থেকে সমস্ত ব্রিফিং, সাইবার বুলিং, এবং অপোনেন্ট নিরোধসহ যাবতীয় অনলাইন কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।

মধ্যরাতে মাইকে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে ‘নাশতা’র ব্যবস্থা হচ্ছে বলে জানা যায়। এমনকি ঘোষণার কিছু সময়ের মধ্যেই কলা-রুটি চলে আসে। আন্দোলন দীর্ঘ হলে সকালে ‘বিরিয়ানি’ দেয়া হবে বলে তারা আশ্বাস দেয়। মাঠে তখন মসজিদের কার্পেট বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা শুয়ে-বসে শবগুজারি করতে থাকি। তাহাজ্জুদের সময় কাছাকাছি হলে মসজিদে প্রবেশ করতে চেষ্টা করি। প্রহরায় নিযুক্ত থাকা ‘টহলবাহিনীর’ অস্মমতি থাকায় নামাজ আর পড়ার সুযোগ হয় না।

মাঝে মাঝে এদিক ওদিক থেকে নানা সংবাদ আসতে থাকে৷ সবদিকে অন্ধকার, কিছু দেখাও যাচ্ছেনা, যখনই কোনোদিকে কিছু ঘটে, উৎসুক ছাত্ররা সব সেদিকে ছুটতে থাকে৷ তাদের সাথে আমরাও ছুটতে থাকি। একসময় শোনা যায়, মাওলানা ওবায়দুল্লাহ হামযাহর খাদেম রাকিবকে ধরে আনা হয়েছে, মেরে মাথা-গা থেঁতলে দেয়া হয়েছে। অন্যদিক থেকে শুনতে পাই মাওলানা ওবায়দুল্লাহ হামযাহর দুই ছেলেকে আটক করে নিয়ে আসা হচ্ছে। সবার সাথে দৌড়ে সেদিকেও ছুটতে থাকি৷

এদিকে মাইকে দালালদের যে যেখানে পলায়নরত অবস্থায় বসে আছে, সবার বিরুদ্ধে রেড এলার্ট জারি করা হয় নাম ধরে ধরে। তখন আন্দোলনকারীদের আওয়াজ উঁচু থাকলেও তাদের এই সাহসের বাস্তবতা কতটা, তা টের পাই আরেকটা ‘মজাদার’ একটি দৃশ্যের মধ্য দিয়ে। মাঠের এক কোণে উপর থেকে কলারুটি ছুড়ে ফেলে একজন, মাঠে বসে থাকা ছাত্ররা ভাবে হামলা হয়েছে। মুহূর্তেই ভোঁ দৌড়। মাঠ খালি হয়ে যায়। সবাই আশ্রয় নিতে চেষ্টা করে মসজিদে। আমি ভাবি, বাহিরে থাকা পুলিশ একটু চিৎকার করলেই তো ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়বে এরা।

ওবায়দুল্লাহ হামযাহ সাহেব সে রাতে বাসায়ই অবস্থান করছিলেন। মাইকে তুইতোকারি সম্বোধন করে বারবার বলা হতে থাকে, বাসা থেকে বের হয়ে এসে ছাত্রদেরকে শান্ত করতে। বাসায় গিয়ে ধরে আনার হুমকিও দিতে থাকে তারা। দফায় দফায় টহলবাহিনীর নির্ধারিত ফোর্সকে পাঠানো হয় তাকে বাসা থেকে ধরে আনতে।

প্রথমবার সরাসরি বাসায় আক্রমণ করে তাকে না পেলে ক্ষিপ্ত হয়ে যায় ‘টহলবাহিনী’। দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে ভেতরে। বাসায় মহিলাদের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও বেডরুম পর্যন্ত তারা তছনছ করে ফেলে। রাগে-গোস্বায় অস্থির হয়ে ফ্রিজের মাছ-গোশত বাইরে ফেলে দেয়া এবং সামনে থাকা আসবাব নষ্ট করে ফেলার মতো কাজ করতেও তারা দ্বিধা করেনা।

প্রায় সাড়ে তিনটার দিকে আমরা দেখতে পাই বিশ-পঁচিশজনের একটা দল তৃতীয় তলা দিয়ে চিৎকার করতে করতে নেমে আসছে। দলটি নীচে নেমে এলে সাক্ষী হই আমার ক্ষুদ্র ছাত্র জীবনের সবচেয়ে নির্মম এবং করুণ একটি দৃশ্যের। একজন উস্তাদকে তাঁরই কাছে পড়া কয়েকজন ছাত্র পাঁজাকোলা দিয়ে ধরে আনছে। উনার বোতামগুলো খোলা। চোখ দিয়ে বেয়ে পড়ছে অসহায় অশ্রু৷ লাঠি হাতে কেউ কেউ মারতে চাইছে।

বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, আমরা দেখতে পাই মুখোশ পরিহিত ‘টহলবাহিনী’র হাতে জিম্মি অবস্থায় মাওলানা ওবায়দুল্লাহ হামযাহকে দ্রুতবেগে ছুটে চলতে হচ্ছে মাঠের মাঝখান দিয়ে সরাসরি মেহমানখানার দিকে। এদিকে মাইকে চিৎকার করে মুহূর্মুহ স্লোগান দেয়া হচ্ছে, ‘এক দফা এক দাবি, ওবায়দুল্লাহ কবে যাবি’।

এরপর পর্যায়ক্রমে তাদের পরিকল্পনা অনুসারে আন্দোলনকারীরা বের করে আনে একেকজন উস্তাযকে। প্রথমে হাফেজ আহমাদুল্লাহ সাহেব এরপর নাযেমে তালিমাত মাওলানা জসীমউদ্দিন সাহেব৷ ফজর পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি এবং অংশগ্রহণেই চলে বৈঠক ও ইস্তফানামা গ্রহণ। ঘোষণা হয় ফজর মাঠেই আদায় করতে হবে। সেন্ট্রাল মাইকে এলাকাবাসীর উদ্দেশে বলা হয় বাহিরে নামাজ আদায় করে নিতে, আজ ভেতরে এসে নামাজ পড়ার সুযোগ নেই। দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টার বন্দিদশা পার করে অজু করার অজুহাতে বের হই মাঠ থেকে৷

ফজরের পর মুখোশের আড়াল থেকে বের হয়ে অনেকেই সাধারণ ছাত্রদের সাথে মিশে যায়। তবুও বিভিন্ন স্থানে সক্রিয় সদস্যরা মুখে কাপড় বেধে প্রহরায় নিযুক্ত থাকে। রুমে ফিরে যেতে চাইলে রাগত ভঙ্গিতে মাঠে অবস্থান করতে বলে। হাফেজ আহমাদুল্লাহ সাহেবকে নিজেদের প্রটোকলে রেখে মাইকের সামনে হাজির করা।

লক্ষ করি, হাফেজ সাহেব হুজুর সবার জন্য কামিয়াবির দুয়া করলেন, যারা রাতভর মাদরাসাজুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, ভাঙচুর করেছে, আমাদের মত নিরীহ ছাত্রদেরকে মারধর করে আন্দোলনে অংশগ্রহণে বাধ্য করেছে। যুলুমের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়ার জন্য হুজুর শুকরিয়াজ্ঞাপনও করেন। খানিকটা মন খারাপ হলেও পরক্ষণেই অনুভব করি, হুজুরের কাছে এসবের পুরোটাই হয়তো অজানা। আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে হুজুর জানবেন কোত্থেকে? হুজুর ধরেই রেখেছেন, সুস্থভাবে হুজুরের প্রতি ছাত্রদের মহব্বতের একটা বহিঃপ্রকাশ এটা। হুজুর ওবায়দুল্লাহ হামযাহর ইস্তফার কথা বলেন, সেইসাথে জানান এগাররোটায় শুরার বৈঠক হবে, সেখানেই হবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। ছাত্ররা এগারোটায় আবার মাঠে ফিরে আসবে, এই ধরনের নির্দেশনা দিয়ে আন্দোলনকারীরা তাদের প্রোটেস্ট সেখানেই ক্ষান্তি দেয়। সব দিক থেকে ছুঁড়ে দেয়া হয় ‘বরকতময়’ কলা-রুটি। হাসি-হাসি মুখে ফিরে যায় উদগ্র আহ্বানে সাড়া দেয়া ‘ছাত্র জনতা। ‘বিরানী’ কালচারকে সম্মান জানিয়ে ‘শাহবাগী’ বাস্তবতার পুনরাবৃত্তি বহুদিন পর পটিয়ার এই আঙিনায় দেখতে পেয়ে আমার ইচ্ছে করে করুণার চাদরে আবৃত এক শীতল-শুভ্র হাসি ফিক করে ছুঁড়ে মারতে প্রতিটি কলায় কলায়, রুটিতে রুটিতে।

আমরা প্রায় সাত ঘণ্টা পর ফিরে আসি উলূমুল হাদিসে। ভাঙচুর হওয়া কামরা দেখে আমাদের প্রচণ্ড মনখারাপ হতে থাকে। কাঁচ পরিস্কার করে স্বাভাবিক রুটিনে ফিরে যেতে চেষ্টা করলেও যাদের বেড কাঁচের কণায় ছেয়ে গেছে, তাদেরকে ঘুমাতেও বেগ পেতে হয়। বেলা এগারোটার দিকে আবারও মাইকের আওয়াজে ঘুম ভাঙে। ছাত্রদেরকে মাঠে জমায়েতের জন্য আদেশ দেয়া হচ্ছে মাইকে। নিরুপায় ভঙ্গিতে বাধ্য এবং অনুগত কর্মীর মত এবারও মাঠে যাওয়ার প্রস্তুতি নিই। রাতে খাবার খাওয়ার পর থেকে পেটে কিছু পড়েনি। ক্ষুধায় অস্থির হয়ে পড়লেও বাহির থেকে কিছু আনার সুযোগ নেই। প্রতিটা গেইটে অন্তত ৬/৭টি করে তালা ঝুলছে। লাঠি হাতে প্রহরায় নিযুক্ত আছে ‘টহল বাহিনী’। মোটামুটি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে ফিলিস্তিনি বাস্তবতা খানিকটা অনুভব করি।

কিছুক্ষণ পর খবর আসে হরতালের কারণে শুরার সদস্যগণ আসতে পারছেন না। শুরার বৈঠক হবে বাদ মাগরিব। ততক্ষণ পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত থাকবে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। বাদ যোহর খাবার খেতে গিয়ে দেখি, আমি যে গার্ডের কাছে খাই, তাকে মেরে হাত অবশ করে ফেলেছে। বেচারা নিরুপায় হয়ে বসে বসে হাতে কীসব তেল-পানি মালিশ করছে।

এরইমধ্যে উস্তায ত্বহা দানিশ হাফিযাহুল্লাহ মারফত জানতে পাই আন্দোলনের সূচনায় তাদেরকে সমর্থন না দেয়া এবং আমাদের দুই ভাইকে মেরে রক্তাক্ত করে পালিয়ে যাওয়ার সময় বিশৃঙ্খলাকারী একজনকে খানিকটা উত্তম মাধ্যম দেয়ার ওরা উলূমুল হাদীসকে প্রতিপক্ষ হিসেবে ধরে নিয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো আক্রমণের শিকার হতে পারি আমরা।

উস্তায আমাদেরকে জানান, যে যেভাবে পারি নিরাপদ পথে মাদরাসা থেকে সরে যেতে অথবা মাদরাসার অভ্যন্তরেই নিরাপদ কোনো আশ্রয়গ্রহণ করতে। এই উশৃঙ্খল ছাত্রদের হাতে কোনোভাবেই আমরা শঙ্কামুক্ত নই। কিন্তু একদিকে গেইট পুরোপুরি বন্ধ অন্যদিকে হামলার আশঙ্কা। আমরা ভয় পেয়ে যাই। তৎক্ষণাৎ ব্যাগ গুছিয়ে ফেলি। ইতোমধ্যেই জামিয়ার পুরাতন ছাত্রদের কল্যাণে অত্যন্ত গোপন একটি পথের সন্ধান পাওয়া যায়। আমরা ব্যাগ ছাড়াই একেবারে খালি হাতে সে পথ দিয়ে প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে একজন একজন করে বেরিয়ে পড়ি। বেরিয়ে পড়ার সময় মনকে বারবার জিজ্ঞেস করতে থাকি, আর কি কখনো ফেরা হবে জামিয়ার এই আঙিনায়? সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর একেকটি সকাল, উস্তাযের সান্নিধ্যের পরশ, দারুল মুতালাআর নিবিড় পাঠ-পরিক্রমা কিংবা তাখরিজ-তামরীন করতে থাকা ব্যস্ত সময়, এসব কি আবার স্বাভাবিকভাবে ফিরে পাওয়া যাবে?

বাসায় ফিরে এসেছি আজ সপ্তাহখানেক হয়ে যাচ্ছে। ঘটনার মোড় একেক সময় একেক দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি আসলে। নিজ থেকে এখন জানতেও ইচ্ছে হচ্ছেনা জামিয়া পটিয়া এখন কোন অবস্থায় আছে। বরং অনাগ্রহ সত্ত্বেও উড়তে থাকা সংবাদে যা শুনছি, পরিস্থিতি সহসা স্বাভাবিক হবার নয়। প্রতিমুহূর্তে ভিন্ন ভিন্ন ক্যারেক্টার এখানে ইনভল্ভ হচ্ছে। ওইযে শুরুতে বললাম, নিজেকে বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রমাণ করতে কেউ এর ভয়ংকর পরিণতিগুলোর কথা ভাবছেনা। ফলে হেফাজত আমীর হযরত মাওলানা মুহিব্বুলাহ বাবুনগরী থেকে শুরু করে হাটহাজারির মুহতামিম মাওলানা খলীল আহমদ কাসেমী, মাওলানা সুলতান যওক নদভী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, মানহাজী ব্লক, সংসদ হুইপ সামশুল হক, আওয়ামী এমপি আবু রেজা নদভী এবং লেবেল লাগানো দালালচক্র, সবাইই এখানে যুক্ত হয়ে আছে। ফলে এটি এখন আর জামিয়ার চারদেয়ালে সীমাবদ্ধ থাকেনি। জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়ে গেছে।

আমরা জানিনা এই সংকট থেকে পরিত্রাণ কবে মিলবে। তবে এ তো জানি, দুআই এখন একমাত্র সম্বল। রব, আপনি আমাদেরকে অন্তত এখানে হক-বাতিল নির্ণয়ে পরীক্ষার মুখে ঠেলে দিয়েন না। আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, মর্যাদা এবং স্বকীয়তাকে অক্ষুণ্ণ রাখার তাওফিক দিন। এই অনাকাঙ্ক্ষিত দ্বৈরথের সমাধানে কোনো ফ্যাসিবাদী শক্তির মুহতাজ যেন না হতে হয়, সে ব্যবস্থাও করে দিন। যাদের হাতে লেগে আছে আমারই ভাইয়ের রক্ত এবং যারা এই মাদারিসে কওমিয়্যাহর প্রত্যক্ষ শত্রু, আমরা আমাদের ভেতরগত দ্বন্দ্বের সমাধানে তাদের দ্বারস্থ হতে চাইনা ইয়া রাব্ব। তেমনিভাবে আমাদের সারেতাজ আকাবিরদের মর্যাদাও অক্ষুণ্ণ রাখার তাওফিক দিন।

অন্যের দ্বন্দ্বের নিরসন করতে গিয়ে তাদের কেউ যেন জীবনের এই অন্তিম মুহূর্তে প্রশ্নবিদ্ধ না হন, কেউ যেন তাদের শানে আঘাত করে কথা বলার সুযোগ না পায়, সে ব্যবস্থা করে দিন। সেইসাথে যে চক্রটি বড়দের সরলতাকে ব্যবহার করে নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির ছক কষেছে, কওমি মাদরাসার স্বকীয়তাকে ভূলণ্ঠিত করেছে, অন্যায়ভাবে আঘাত করে নিজের ভাইকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে, উস্তাযকে অসম্মানিত করেছে, মাদরাসার বিপুল ক্ষয়-ক্ষতি করেছে, তাদের ব্যাপারে আপনিই একমাত্র হাকেম।

নিজেদের নির্দ্বিধ পড়ালেখার অধিকার, নিরাপদ চলাফেরার অধিকার, আত্মসম্মানবোধ ধরে রাখার অধিকার, সবকিছু হারিয়ে, অপমান-অপদস্থতাকে মাথায় নিয়ে আপনার দরবারে এসে হাজির হয়েছি, আপনি সীরাতে মুস্তাকিমের পথ দেখিয়ে মুক্ত করুন আমাদেরকে, এ কওমি মাদরাসাকে, সর্বোপরি এ উম্মাহকে।

এ জাতীয় আরো সংবাদ

ভাষা আন্দোলন বঙ্গবন্ধুই শুরু করেছিলেন: প্রধানমন্ত্রী

নূর নিউজ

কেন বাড়ছে বিবাহবিচ্ছেদ? কারণ ও প্রতিকার

আনসারুল হক

ইফতারি হোক অমুসলিমদের সাথে

নূর নিউজ