ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) বেশকিছু বিভাগে তীব্র সেশনজট সৃষ্টি হয়েছে। দেড় বছর ধরে মহামারী করোনার ক্ষতি কাটিয়ে আবারও তীব্র সেশনজটের কবলে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। এতে চরম ভোগান্তি, পরিবারের চাপ, মানসিক চাপ, ও ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা। শিক্ষার্থীরা বিসিএস, বিজেএসসহ নানা সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে পিছিয়ে পড়ছে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবং সেশনজট নিরসনে রোডম্যাপ তৈরি করলেও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
সেশনজটের পেছনে কয়েকটি বিষয়কে দায়ী করেছেন সচেতন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন- সান্ধ্যকালীন কোর্স, ঠিক সময়ে পরীক্ষা না নেওয়া, পরীক্ষার তারিখ পেছানো, ফল প্রকাশে ধীরগতি, শিক্ষকদের অবহেলা, অর্ডিনেন্সের বাইরে কার্যক্রম পরিচালনা সৃষ্ট জটিলতা, রাজনীতিতে শিক্ষকদের ব্যস্ততাসহ নানা বিষয়ের কারণে সেশনজট তৈরি হয়েছে।
অন্যদিকে বিভাগগুলোর সভাপতিগণ প্রশাসনিক জটিলতাসহ বিভিন্ন বিষয়কে দায়ী করেছেন। এ বিষয়ে সিএসই বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. রবিউল হক বলেন, এখন সেশনজট অনেকটাই কমে এসেছে। শিক্ষকদের আন্তরিকতা থাকলে খুব শীঘ্রই স্বাভাবিকতা ফিরবে। প্রশাসনিক জটিলতার কারণেও এটি হয়। কারণ একটি ফাইল পাঠালে সেটি পুনরায় খোঁজখবর না নিলে সেটির অনুমোদন হয় না।
সেশনজটে থাকা বিভাগগুলো হলো- আল-ফিকহ অ্যান্ড লিগ্যাল স্টাডিজ, বাংলা, ইংরেজি, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, আইন, বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি, ম্যানেজমেন্ট, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং, গণিত এবং পরিসংখ্যান বিভাগ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইইই, ইংরেজি ও বাংলা বিভাগে ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থীরা এখনও একাডেমিক লাইফ শেষ করতে পারেনি। বিভাগগুলো মাস্টার্স শেষ করলেও ফলাফল প্রকাশিত হয়নি। একই সেশনের অন্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা করোনার ছুটি ব্যতিরেকে যথাক্রমে এক-দেড়বছর আগে মাস্টার্স শেষ করে শিক্ষাজীবনের ইতি টেনেছেন।
বিভাগুলোর ২০১৬-১৭ সেশনের শিক্ষার্থীরা এখনও মাস্টার্স শেষ করতে পারেনি। কোন কোন বিভাগে অনার্স শেষ করে কেবলমাত্র মাস্টার্সের ক্লাস শুরু করেছে। এতে তাদের পড়াশোনা সম্পন্ন করতে প্রায় ৭-৮ বছর লেগে যাচ্ছে বলে দাবি করেছেন শিক্ষার্থীরা।
জানা গেছে, আল-ফিকহ্ অ্যান্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগে এ বর্ষের অনার্সের পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। তবে এখনও অনার্সের ইমপ্রুভমেন্ট ও রিটেক পরীক্ষা শুরু হয়নি। এদিকে তাদের মাস্টার্সের ক্লাস চলমান রয়েছে। পরিসংখ্যান বিভাগে অনার্সের পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মাস্টার্সের প্রথম সেমিস্টার ক্লাস শুরু হয়েছে। সিএসই, বায়োটেক ও গণিত বিভাগে মাস্টার্সের প্রথম সেমিস্টার ক্লাস চলছে তবে এখনও ভর্তি কার্যক্রম শেষ হয়নি।
সিএসই বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সিরাজুল ইসলাম বলেন, একই সেশনের অন্য বিভাগের বন্ধুরা মাস্টার্স শেষ করে চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেখানে আমরা মাস্টার্সের ক্লাস করছি। এদিকে সরকারি চাকরির বয়স শেষের দিকে হওয়ায় হতাশায় ভুগছি।
এদিকে বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীদের মাস্টার্সে এক বছর ধরে ক্লাস চললেও এখনও সেমিস্টার ফাইনালে বসতে পারেনি তারা। এ বিভাগের শিক্ষার্থী শাহীন আলম বলেন, ছাত্র জীবনে সেশনজট সবচেয়ে হতাশার ব্যাপার। একই সেশনে ভর্তি হয়ে অন্য বিভাগের সহপাঠীরা এক-দেড় বছর আগে ক্যাম্পাস ছাড়লেও আমাদের বিভাগ কচ্ছপ গতিতে এগিয়ে চলছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত বিভাগগুলোর জট নিরসনে বিশেষ অর্ডিন্যান্স জারি করা।
আইন বিভাগের শিক্ষার্থীদের অনার্সের রিটেক-ইম্প্রুভ পরীক্ষার ফল প্রকাশিত না হওয়ায় এখনও মাস্টার্সের ভর্তি সম্পন্ন হয়নি। তবে প্রথম সেমিস্টারের ক্লাস প্রায় শেষ হয়েছে। ইংরেজি বিভাগে মাস্টার্সের প্রথম সেমিস্টারের ক্লাস-ফরম ফিলআপ শেষ হলেও এখনও পরীক্ষা শুরু হয়নি। ইইই বিভাগে মাস্টার্স প্রথম সেমিস্টারের ক্লাস চলছে।
ইইই বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. শাহীনুজ্জামান বলেন, করোনাকালীন কিছু সেশনজট রয়েছে। এখন বিভাগে গতিশীলতা ফিরে এসেছে। যেটুকু জট আছে তা আশা করি কাটিয়ে উঠবে।
আইসিটি বিভাগের শিক্ষার্থীদের মাস্টার্সের দ্বিতীয় সেমিস্টারের ক্লাস চলছে। এছাড়া ম্যানেজমেন্ট বিভাগে মাস্টার্স প্রথম সেমিস্টারের ক্লাস চলছে। ফিনান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগে মাস্টার্স প্রথম সেমিস্টারের পরীক্ষা শুরু হয়েছে। তবে একই সেশনে ভর্তি হওয়া অন্য বিভাগগুলোর শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা শেষ করে চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এদিকে এসব বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা এখনও অনার্স শেষ করতে পারেনি। এতে করোনার ছুটি ব্যতিরেকে প্রায় এক বছরের সেশনজটে পড়েছে এসব শিক্ষার্থীরা।
পরিসংখ্যান বিভাগে তৃতীয় বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টার পরীক্ষা চলমান। আল-ফিকহ্, সিএসই, ইইই ও গণিত বিভাগের চতুর্থবর্ষের প্রথম সেমিস্টার চলমান। ম্যানেজমেন্ট ও বাংলা বিভাগে প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এদিকে ইংরেজি, ফিন্যান্স, আইসিটি ও বায়োটেকের দ্বিতীয় সেমিস্টারের ক্লাস চলমান। আইন বিভাগের দ্বিতীয় সেমিস্টারের পরীক্ষা চলমান।
আল-ফিকহ অ্যান্ড লিগ্যার স্টাডিজ বিভাগের সভাপতি ড. নাছির উদ্দীন বলেন, সেশনজট কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করছি। এটি সম্মিলিত কাজ এজন্য সববাই আন্তরিক থাকলে আগামীতে কোন জট থাকবে না।
তবে একই সেশনে ভর্তি হওয়া অন্য বিভাগগুলোর শিক্ষার্থীরা অনার্স শেষ করেছে ছয়মাস আগে। এতে আরও সেশনজট দীর্ঘ হওয়ার শঙ্কা। এখনই সেশনজট প্রতিকারে উদ্যোগ না নিলে শিক্ষাজীবন শেষ করতে প্রায় ৭-৮ বছর লাগতে পারে বলে দাবি করছেন শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে এসব বিভাগের ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষেরও এক সেমিস্টারের সেশনজট তৈরি হয়েছে।
পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী রাজিন বলেন, অন্য বিভাগের আমাদের পরের সেশন মাস্টার্সের ক্লাস করছেন। আমাদের ফাইনাল ইয়ারের রেজাল্ট হয়নি। আমরা আমাদের ক্যারিয়ার নিয়ে ধোঁয়াশায় আছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম বলেন, বিভাগগুলোয় সেশনজট কমাতে বিভাগের শিক্ষকদের আন্তরিক হতে হবে। আমরা নির্দেশনা দিতে পারি। আমরা তো আর যেয়ে পরীক্ষার খাতা দেখে আসব না! একাডেমিক জটিলতা থাকলে আমার সঙ্গে আলোচনা করলে আমি অবশ্যই সেটার সমাধান করে দেব। শিক্ষার্থীদেরও উচিত শিক্ষকদের কাছ থেকে ক্লাস পরীক্ষা আদায় করে নেওয়া।
সুত্র: ঢাকা পোস্ট