ইন্দোনেশিয়ার পাম অয়েল রপ্তানি বন্ধ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে দামবৃদ্ধির অজুহাতে ভোজ্যতেলের বাজারে আবার অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। ঈদ ঘিরে অতি মুনাফার আসায় কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ানো হয়েছে। শনিবার প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন ১৭৫ টাকায় বিক্রি হলেও রোববার ১৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে সোমবার লিটারে ২০ টাকা বেড়ে সর্বোচ্চ ২০০ টাকায় সয়াবিন বিক্রি হয়েছে। এক মাস আগে দাম ছিল ১৬০ টাকা। এতে ভোক্তাদের আবারও নাজেহাল হতে হচ্ছে।
আসন্ন রমজান ও ঈদুলফিতর উপলক্ষ্যে সয়াবিন তেলের দাম সহনীয় রাখতে আমদানি, উৎপাদন ও বিপণন পর্যায়ে ৩০ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে। পরিশোধিত ও অপরিশোধিত সয়াবিন তেলে এ সুবিধা ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিত্যপণ্য আমদানিতে এলসি মার্জিন প্রত্যাহার করে। একই সঙ্গে এলসি কমিশনও সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এছাড়া বাজারে তদারকি বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে বন্দর থেকে দ্রুত পণ্য খালাসের ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। পণ্যমূল্য তদারকিতে সরকার টাস্কফোর্স গঠন করলেও লাগাম টেনে ধরতে পারছে না।
গত কয়েকদিন কারসাজি বন্ধ থাকলেও ঈদ ঘিরে আবারও একটি চক্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বোতলজাত তেলের গায়ে মূল্য লেখা থাকায় এবার খোলা সয়াবিন নিয়ে কারসাজি শুরু হয়েছে। এ তেলের একটি বৃহৎ শ্রেণির ক্রেতা থাকায় সরবরাহ কমিয়ে দাম বাড়ানো হচ্ছে। পাশাপাশি মূল্য বেশি পাওয়ার আশায় বোতলজাত সয়াবিন জারের তেল ঢেলে খোলা তেল হিসাবে বিক্রি হচ্ছে। ফলে বোতলজাত সয়াবিনেরও তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, ভোজ্যতেলের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমরা তদারকি করছি। কয়েকদিন পরপর কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের তলব করছি। কী পরিমাণে তেল আমদানি করছে, কত দরে বিক্রি করছে, সরবরাহ কত পরিমাণে করছে-এসব খতিয়ে দেখছি। তবে আবার কেন দাম বাড়ল এবং কারা দাম বাড়াল, তা আমরা তদারকি শুরু করেছি। মূল্য নিয়ন্ত্রণে তেল কোম্পানির প্রতিনিধিদের আবারও ডাকা হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ায় মিল মালিকরা ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু সরকার এ দাবি নাকচ করে দিয়ে বলছে-ঈদের পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এদিকে ঈদ সামনে রেখে ভোজ্যতেলের চাহিদা বাড়ায় সয়াবিনের সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। মিল মালিকরা সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ায় বাজারে কৃত্রিম সংকটের সৃষ্টি হয়েছে বলে খুচরা ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন। তবে মিল মালিকরা বলছেন, তারা চাহিদা অনুযায়ী তেলের জোগান দিয়ে যাচ্ছেন। সরবরাহ কমানো হয়নি।
জানা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লেও সেই তেল দেশের বাজারে আসতে দুই থেকে তিন মাস লেগে যাবে। কিন্তু একটি চক্র এখনই দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
সর্বশেষ ২০ মার্চ সরকারের পক্ষ থেকে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিনের দাম ১৩৬ টাকা ও বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। তবে সোমবার এ দামে বাজারে তেল পাওয়া যায়নি। এ দিন প্রতিলিটার খোলা সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ১৯৫-২০০ টাকা, যা একদিন আগে রোববার ১৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর শনিবার বিক্রি হয়েছে ১৭৫ টাকায়। এর এক মাস আগে ১৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পাশাপাশি প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন ১৭০-১৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা এক মাস আগে ১৬৫-১৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
অন্যদিকে সরকার প্রতি লিটার পাম অয়েলের দাম ১৩০ টাকা নির্ধারণ করে। কিন্তু এ দামে বাজারে পাম অয়েল পাওয়া যায়নি। এক মাস আগে ছিল ১৪০ টাকা লিটার। এক সপ্তাহ আগে ছিল ১৫০ টাকা। দুই দিন আগে ছিল ১৬০ টাকা। রোববার বাজারে প্রতি লিটার পাম অয়েল ১৭৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এর ২৪ ঘণ্টা পর সোমবার প্রতি লিটারে ৫-১০ টাকা বেড়ে পাম অয়েল ১৮০-১৮৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়লে দেশের বাজারেও এর প্রভাব পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। তবে তেলের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ে ভ্যাট মওকুফ করা হয়েছে। এসবের তদারকি জোরদার করতে হবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজার পর্যালোচনা করতে হবে। আর দাম বাড়াতে হলে ভোক্তার স্বার্থ বিবেচনায় আর কীভাবে সহায়তা দেওয়া যায়, তা পর্যালোচনা করে সরকারের পক্ষ থেকে যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করতে হবে। পাশাপাশি টিসিবির মজুত বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের কাছে ভর্তুকি মূল্যে সরবরাহ করতে হবে। এতে সাধারণ মানুষ একটু হলেও স্বস্তিতে থাকতে পারবে।
রাজধানীর জিনজিরা কাঁচাবাজারের মুদি দোকানদার সাক্কুর আলম বলেন, ১০ কাটুন বোতলজাত সয়াবিন তেলের অর্ডার করলে দুই থেকে তিন কাটুন পাওয়া যায়। গত এক মাসে পাইকারি বাজারে খোলা তেলের দাম কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে। তাই বেশি দরে তেল এনে বেশি দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বাজারে খোলা তেল নেই। পাইকাররা সরবরাহ করছে না। বোতলজাত সয়াবিনের গায়ে মূল্য লেখা থাকলেও খোলা তেলে কোনো দর লেখার সুযোগ নেই। আর খোলা তেলের বৃহৎ ক্রেতা রয়েছে। যারা দরিদ্র ও হতদরিদ্র, তারা এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন একসঙ্গে কিনতে পারেন না। ফলে তারা ছটাক ধরে খোলা সয়াবিন তেল কেনেন। তাই অসাধুরা খোলা তেলের দিকে নজর দিয়েছে।
সূত্র জানায়, দেশে সয়াবিন ও পাম অয়েলের চাহিদার চেয়ে বেশি মজুত রয়েছে। যে পরিমাণ অপরিশোধিত তেল আমদানি হয়েছে, সেগুলো দিয়ে কমপক্ষে আরও তিন মাস চলবে। এদিকে বাড়তি দামে যেসব তেল আমদানি হবে সেগুলোর মধ্যে মালয়েশিয়া থেকে পাম অয়েল দেশে আসতে দুই মাস লাগবে। এগুলো পরিশোধিত হয়ে খুচরা বাজারে আসতে আরও দুই মাস লাগবে। সব মিলিয়ে আরও চার মাস সময় লেগে যাবে। অন্যদিকে ব্রাজিল, কানাডা, ইউক্রেন ও চীন থেকে সয়াবিন তেল আমদানি হয়। এসব দেশ থেকে বাড়তি দামে সয়াবিন আসতে কমপক্ষে তিন মাস লাগবে। সেগুলো পরিশোধিত হয়ে বাজারে আসতে সময় লাগবে আরও দুই মাস। কিন্তু বাজারে ইতোমধ্যে দাম বেড়ে গেছে। অথচ এসব তেল কমপক্ষে তিন মাস আগে আমদানি করা হয়েছে।
রাজধানীর মৌলভীবাজার পাইকারি ভোজ্যতেল বিক্রেতা সালাউদ্দীন বলেন, আমাদের বেশি দর দিয়ে এখনো আনতে হচ্ছে। পাশাপাশি এখন পাইকারি বাজারে সরবরাহ কম। তাই দাম বেড়েছে। ফলে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বাড়তি দরে বিক্রি করতে হচ্ছে।