হাফেজ হয়ে মায়ের স্বপ্ন পূরণ করা হলো না ডেমরা এলাকার ‘বাইতুস সুজুদ মাদরাসার হিফজ বিভাগের ছাত্র ইব্রাহিমের। মায়ের স্বপ্ন পূরণ করে কুরআনের হাফেজ হওয়ার আগেই মাত্র ১৩ বছর বয়সে শহীদের মর্যাদা পেয়েছে ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ।
২০২৪ সালের ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে সে মারা যায়।
সেই দিনের কথা স্মরণ করে সখিনা বিবি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘ছেলেটা না খেয়ে ছিল, ঘরে খাবার ছিল না। আমি নিজেই সেদিন না খেয়ে ছিলাম। ভাবছিলাম, ও বাসায় ফিরলে যে সামান্য আটা আছে, তা দিয়ে রুটি বানিয়ে খাওয়াবো।’
শৈশব থেকেই সে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বেড়ে উঠলেও তার কোমল মন কখনোই উপলব্ধি করতে পারেনি কতটা নির্মম দমনপীড়ন চালানো হচ্ছে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিকে দমন করতে।
ইব্রাহিমের মা সখিনা বিবি মানুষের বাসাবাড়িতে কাজ করে সন্তানদের দু-বেলা দু-মুঠো খাবার জোগাড় করার চেষ্টা করতেন। তবু অভাব-অনটনের কারণে প্রায়ই অনাহারে থাকতে হতো তাদের।
এই দুঃখজনক কাহিনি ইব্রাহিমকেও ছাড় দেয়নি। শহীদ হওয়ার দিনেও সে ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘর থেকে বের হয়েছিল। সেদিনও ঘরে খাবার ছিল না।
ইব্রাহিম ঢাকার ডেমরা এলাকার ‘বাইতুস সুজুদ মাদরাসা’র হিফজ বিভাগের ছাত্র ছিল। ইতোমধ্যে সে কোরআনের ছয় পারা মুখস্থ করেছিল। তার বড় ভাই ইয়াকুব আলীও একই মাদরাসা থেকে দুই বছর আগে হেফজ শেষ করে কওমি ধারায় আলেম হওয়ার লক্ষ্যে পড়াশোনা করছিল।
কিন্তু ইব্রাহিমের মৃত্যুর পর পরিবারের হাল ধরতে ইয়াকুবকে পড়ালেখা বন্ধ করে গুলিস্তানের একটি টি-শার্ট শোরুমে কাজ নিতে হয়। কারণ মা সখিনা অসুস্থ হয়ে যান এবং আর কাজ করতে পারেন না।
নিজের সংগ্রামী জীবনের কথা বলতে গিয়ে সখিনা বলেন, ‘স্বামী আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর আমি আর বিয়ে করিনি। ভেবেছিলাম, দুই ছেলেকে হাফেজ বানাবো।’
‘বড় ছেলেকে দিয়ে পুরো কোরআন হেফজ করাতে পেরেছিলাম। সে এখন কওমি মাদ্রাসায় নাহু-মীর শ্রেণির (অষ্টম শ্রেণির সমতুল্য) ছাত্র ছিল। কিন্তু ভাগ্য সহায় হলো না। স্বপ্ন পূরণের আগেই আমার ছোট ছেলেকে হারালাম।’
ইব্রাহিমের মৃত্যুর দিন শুক্রবার (১৯ জুলাই) সকালবেলা সে সখিনাকে একটি ভিডিও দেখায়। আগের দিন সাইনবোর্ড এলাকায় ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর দৃশ্য সে মোবাইলে ধারণ করেছিল।
সখিনা নির্দিষ্ট তারিখ মনে রাখতে পারেননি। তিনি শুধু মনে রেখেছেন, ওই দিন রাত ১২টা থেকে সরকার সারা দেশে কারফিউ জারি করেছিল।
ভিডিওটি দেখে সখিনা রেগে গিয়ে তাকে বকাঝকা করেন, ‘তুই ওখানে কেন গেছিলি? তোদের মতো গরিব ছেলেদের কি আন্দোলনে যাওয়া দরকার? মরার জন্য গেছিস? আর কখনও ওখানে যাবি না।’
ছেলের প্রতিক্রিয়ায় সখিনা বলেন, ‘সে কথা দিয়েছিল আর যাবে না। আমি বলেছিলাম, আমি কাজে না ফেরা পর্যন্ত কোথাও যাবি না।’ কিছুক্ষণ পর সে পাশের বাসায় খালার বাড়িতে যায় এবং খেলাধুলা করতে থাকে।
সখিনা বলেন, ‘আমি কাজ থেকে ফিরে দেখি, সে গোসল করে জুমার নামাজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।’ নামাজ শেষে সে পাঞ্জাবি পরে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। তবে কোথায় যাচ্ছে মাকে কিছু বলে যায়নি। জোহরের নামাজ পড়ার সময় জানালার ফাঁক দিয়ে সাখিনা দেখে, ইব্রাহিম ঘরে ফিরছে।
তিনি বলেন, ‘ভাবলাম, আমার নামাজ শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করবে। কিন্তু সে অপেক্ষা না করে আবার বেরিয়ে যায়। নামাজ শেষে খুঁজতে গিয়ে কোথাও পাইনি। ভেবেছিলাম, আশেপাশেই আছে। কিন্তু সে আর ফেরেনি।’
‘সেদিন কেমন যেন মন খারাপ ছিল। জোহরের নামাজ শেষে অকারণেই অনেক কাঁদলাম। একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম।’ বিকাল ৪টার দিকে ঘুম ভেঙে ওঠেন সখিনা। তখন বাচ্চাদের জন্য খাবার তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
আসরের আজানের ধ্বনি শোনার পর ঠিক করেন নামাজ শেষে রান্না করবেন। নামাজের পর আবারও কান্না আসছিল, কিন্তু তখনও বুঝতে পারেননি তার ছেলে চিরতরে চলে যাবে।
‘নামাজ শেষে হঠাৎ কেউ আমার ছেলের মোবাইল সিম দিয়ে ফোন করে জানায়, আমার ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। তার মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।’
এই খবর পেয়ে তিনি কোনোভাবে মাদরাসায় গিয়ে বড় ছেলেকে জানান, ‘তোর ভাই মারা গেছে।’ এরপরই অজ্ঞান হয়ে পড়েন সখিনা।
জ্ঞান ফিরে আসার পর বড় ছেলেকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে যান। সেদিনই মরদেহ হাতে পাননি। পরদিন শনিবার তারা ইব্রাহিমের লাশ গ্রহণ করেন এবং মাতুয়াইল কবরস্থানে দাফন করেন।
ইব্রাহিম কোথায় নিহত হয়েছিল তা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি সখিনা। তিনি শুধু বলেন, ‘ছেলের পায়ে ও মাথার পেছনে গুলির দুটি চিহ্ন ছিল।’
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগে ভেঙে পড়েন সখিনা। তিনি বলেন, ‘ইব্রাহিম প্রায়ই বলত, আমি পুরো কোরআন হেফজ শেষ করে বিদেশ যাবো, টাকা পাঠাবো, তুমিও ভালো থাকবে।’
‘তোমার কোনো কষ্ট থাকবে না, আমি টাকা পাঠিয়ে তিনতলা বাড়ি বানাবো। আমি দেশে ফিরে এসে সেই বাড়িতেই তোমার সঙ্গে থাকব।’ এই স্বপ্নই মাকে দেখাত ইব্রাহিম। সন্তানের মৃত্যুতে শোকে কাতর মা সখিনা তাঁর ছেলের হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেন। সূত্র: বাসস