সংসার, বিয়ে একজন মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সুস্থ-স্বাভাবিক পারিবারিক জীবনে নানা কারণে দেখা দেয় তালাকের মত খড়গ কৃপাণ। এরপরও থেমে থাকে না জীবন, চলে আপন গতিতে। তালাকের মাধ্যমে জীবনের সুদৃঢ় বৈবাহিক জীবনে বিচ্ছেদ ঘটলেও এমন দম্পতি আবারো নিজেদের এক সম্পর্কে বাঁধতে চাইলে ইসলামি শরীয়তে দেওয়া হয়েছে হিল্লা বিয়ের বিধান।
হিল্লা বিয়ে ইসলামি ইতিহাসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগ থেকেই স্বীকৃত। এই শতাব্দীর রচিত কোন কুসংস্কার নয়। ইসলামি বিধানের বিরোধিতার ধারা অব্যাহত সেই নববী যুগ থেকে বিশ্বায়নের এই আধুনিককালেও। সম্প্রতি শরীয়তে ইসলামিতে স্বীকৃত হিল্লা বিয়েকে কুসংস্কার বলে এর উপর নানা আপত্তি তুলতে দেখা গেছে। এ নিয়ে দেশের অন্যতম ফিকহ বিশেষজ্ঞ, রাজধানীর শাইখ যাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের মহাপরিচালক মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ jকথা বলেছেন গণমাধ্যমের সঙ্গে।
‘অজ্ঞতার কারণেই ইসলামে স্বীকৃত হিল্লা বিয়েকে কুসংস্কার বলেন কথিত বুদ্ধিজীবীরা’
তিনি বলেছেন, যারা হিল্লা বিয়েকে কুসংস্কার বলতে চায় তারা হিল্লা বিয়ের সংজ্ঞাই জানেন না। হিল্লা নিয়ে অজ্ঞতার কারণেই আজকাল কথিত বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে অহেতুক আপত্তি দেখা দিচ্ছে।
‘দেশে দুই ধরণের হিল্লা বিয়ে প্রচলিত’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে দুই ধরনের হিল্লা বিয়ে চালু আছে, একটা হল দেশের সমাজে প্রচলিত হিল্লা, অপরটি ইসলামি শরীয়ত নির্ধারিত হিল্লা’।
শরীয়ত নির্ধারিত হিল্লা
শরীয়ত নির্ধারিত হিল্লা বিয়ের নিয়ম হলো; তালাকের মাধ্যমে বিচ্ছেদের পর স্বামী-স্ত্রী আবারো এক সাথে সংসার করতে চাইলে স্ত্রীকে অন্য আরেকজনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে এবং তার সাথে সংসার করতে হবে, এমনকি বুখারী শরীফের হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বিতীয় স্বামীর সাথে সেই নারীর সম্ভোগের কথা স্পষ্ট করে বলেছেন। এরপর দ্বিতীয় স্বামী সেই মহিলাকে তালাক দিলে অথবা সে মারা গেলে এই মহিলা তার প্রথম স্বামীর সাথে আবারো শরয়ী নিয়ম মেনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে।
তিনি বলেন, এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় হল, দ্বিতীয় স্বামীর সাথে বিয়ের ক্ষেত্রে কোন ধরনের চুক্তি হতে পারবে না যে, দ্বিতীয় স্বামী তাকে কিছু সময় রেখে তালাক দিয়ে দেবেন। এটা হল হিল্লায় শরয়ী।
বর্তমান সমাজে প্রচলিত হিল্লা
এর বাইরে আমাদের সমাজে বর্তমানে যে প্রচলিত হিল্লা বিয়ে হয়ে থাকে, সেখানে চুক্তির মাধ্যমে কিছুক্ষণ নারীকে রেখে তালাক দিয়ে দেওয়া হয়। মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদের ভাষায়, প্রচলিত এই হিল্লা বিয়ের বিরোধিতা করে থাকেন স্বয়ং দেশের শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরামগণ। বর্তমানে যারা হিল্লা বিয়েকে কুসংস্কার বলছেন তারা যদি সমাজে প্রচলিত হিল্লা বিয়ে নিয়ে কথা বলেন তাহলে এতে আমাদের কোন আপত্তি নেই, কিন্তু যদি তাদের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে ইসলামি শরীয়ত সমর্থিত হিল্লা বিয়ের বিরোধিতা করা এবং একে কুসংস্কার বলা, তাহলে কোরআন-হাদিস অস্বীকার করার কারণে তাদের ঈমানহারা হওয়ার সম্ভাবনা প্রকট।
এই ফকিহ বিষেশজ্ঞের ভাষায়, বর্তমানে বুদ্ধিজীবী ভাব ধরেন এমন মানুষেরা শরীয়ত নির্ধারিত ও সমাজে প্রচলিত হিল্লার মাঝে পার্থক্য করতে না পেরে ঢালাওভাবে একে কুসংস্কার বলেন এটা অনেক দুঃখজনক।
‘রাসূল সা. ও সাহাবায়ে কেরাম উম্মতকে হিল্লা ( কৌশল) শিখিয়েছেন’
তিনি বলছেন হিলা অর্থ হলো কৌশল অবলম্ন করা, বিষয়টি স্পষ্ট করতে হয় গিয়ে বুখারী শরীফের হাদীসের উদ্ধৃতি টেনে মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ বলছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযা সালাম-এর কাছে একবার খায়বার থেকে কেউ আজওয়া খেজুর হাদিয়া নিয়ে এলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন খাইবারের সব খেজুরই কি উন্নত মানের হয়ে থাকে?
জবাবে তিনি জানিয়েছিলেন, না হুজুর ভালো-মন্দ মিলিয়ে খায়বারের খেজুর, আপনাকে হাদিয়া দেওয়ার জন্যখারাপ কোয়ালিটির ২ কেজি খেজুরের বিনিময়ে ভালো কোয়ালিটির ১ কেজি আজওয়া খেজুর কিনেছি।
একথা শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বলেছিলেন, তুমি তো মারাত্মক ভুল কাজ করেছ; ২ কেজি দিয়ে এক কেজি নেওয়া এটা রিবা (সুদ) ‘র মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।
এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম তাকে একটি হিলা (কৌশল) শেখালেন, বললেন, তুমি বিষয়টিকে সুদ মুক্ত করতে চাইলে প্রথমে তোমার ২ কেজি নিম্ন মানের খেজুরকে বিক্রি করবে ১ দিনারে। এরপর এই ১ দিনারের বিনিময়ে উন্নত মানের এক কেজি খেজুর কিনবে, এই কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে বিষয়টিকে তুমি সুদ মুক্ত করতে পারবে।
ইসলামের ইতিহাসে শুরু থেকেই হিল্লার বিষয়টি স্বীকৃত। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম নিজে যেভাবে উম্মতকে হিলা শিক্ষা দিয়েছেন খেলাফতে রাশেদার যুগেও এর বিভিন্ন উদাহরণ রয়েছে।
আমিরুল মুমিনীন হযরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু-এর যুগের ঘটনা বলেছেন মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ এভাবে; আমিরুল মুমিনীন ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু-এর দরবারে একজন অবিবাহিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে জেনার মামলা এলো। জেনাকারী অবিবাহিত হলে এক্ষেত্রে শরীয়ত নির্ধারিত শাস্তি হলো ১০০ বেত্রাঘাত, কিন্তু যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে এ অপরাধ সাব্যস্ত হয়েছিল তিনি ছিলেন অত্যন্ত হ্যাংলা পাতলা, ১০০ বেত্রাঘাত দূরের কথা ১০ বেত্রাঘাত সহ্য করার মত ক্ষমতাও তার ছিল না। একদিকে শরয়ী বিধান, অন্যদিকে সে ব্যক্তির জীবন রক্ষা করা জরুরি।
তখন সব দিক বিবেচনা করে আমিরুল মুমিনীন হযরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ১০০ টি বেত একত্রিত করে তাকে প্রহার করার নির্দেশ দিলেন, এতে একেবারে ১০০ টি বেতের মার তার উপর পতিত হওয়ায় শরীয়ত নির্ধারিত শাস্তি প্রয়োগের সাথে সাথে তার জীবনও রক্ষা পেল।
মানুষ যেন শরীয়ত নির্ধারিত বিধান সহজেই পালন করতে পারেন এজন্য নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম-এর মত সাহাবায়ে কেরামও অসংখ্য কৌশল শিখিয়েছেন, যা উম্মতের জীবনকে সহজ করে দিয়েছে।
হিল্লা: ‘কুসংস্কার নয় তালাকের মাধ্যমকে হারাম হয়ে যাওয়া সাংসারিক সম্পর্ককে পুনরায় বৈধ করে’
শরীয়ত মানুষের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে এমন নানা ধরনের কৌশল অবলম্বন করেছে আর এরই অংশ হলো হিল্লা বিয়ে, যেখানে তালাকের মাধ্যমে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বন্ধন; সাংসারিক সম্পর্ক আজীবনের জন্য হারাম হয়ে যায়, তাকে পুনরায় হালাল উপায়ে ফেরাতে এই হিল্লার (কৌশল অবলম্বন) বিধান দেওয়া হয়েছে শরীয়তের পক্ষ থেকে।
শরীয়তের এই সূক্ষ্ম কৌশল বুঝতে অপারগ হলে এ নিয়ে চুপ থাকাই উচিত, এমন বেফাঁস মন্তব্য কখনোই কাম্য নয়, যার মাধ্যমে নিজের ঈমানের ক্ষতি হয়ে যায়-বলছিলেন মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ।