আফগানিস্থানে কট্টরপন্থী দমনে কেন ব্যর্থ হলো মার্কিন বাহিনী?

আফগানিস্তানে সন্ত্রাসবাদ ও উগ্র গোষ্ঠীগুলোর মোকাবেলায় মার্কিন ব্যর্থতার কারণ সম্পর্কে আলোচনা করব। যুক্তরাষ্ট্র ২০০১ সালে সন্ত্রাসবাদ দমন বিশেষ করে উগ্র আল কায়দা গোষ্ঠীকে দমনের কথা বলে আফগানিস্তানে হামলা চালিয়ে ব্যাপক সেনা সমাবেশ ঘটায়। এরপর ২০ বছর অতিক্রান্ত হলেও তারা সন্ত্রাস দমন করতে তো পারেনি এমনকি আফগানিস্তান থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। চলুন তাহলে আফগানিস্তানে মার্কিন ব্যর্থতার কারণ জেনে নেয়া যাক।

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। যদিও ওই হামলার সঙ্গে কারা জড়িত তা এখনো স্পষ্ট নয় কিন্তু ওই ঘটনাকে অজুহাত করে ওয়াশিংটন সন্ত্রাসবাদ দমনের কথা বলে আফগানিস্তানে ব্যাপক সামরিক আগ্রাসন চালায় এবং দেশটি দখল করে নেয়। কিন্তু গত ২০ বছরে বিশ্ববাসী দেখেছে মার্কিন সরকারের দৃষ্টিতে যারা সন্ত্রাসী অর্থাৎ ওই আল কায়দা গোষ্ঠীকেই আফগানিস্তানে আশ্রয় দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র এবং শেষ পর্যন্ত তাদের সঙ্গেই সমঝোতা করে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিয়েছে হোয়াইট হাউজ। যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা চিন্তাবিদ ও বিশ্লেষক ম্যাক্স আব্রামস্‌ এ ব্যাপারে বলেছেন, মার্কিন সরকার আল কায়দা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে দমন এবং বিন লাদেনকে ধরার জন্য আফগানিস্তানে ব্যাপক সেনা সমাবেশ ঘটালেও ২০ বছর পরে এসে মার্কিন সরকার এখন তালেবানকে অনুরোধ করে বলেছে উগ্র তাকফিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দায়েশ বা আইএসের হাত থেকে মার্কিন সেনাদের রক্ষায় তালেবান যেন সহযোগিতা করে।

যুক্তরাষ্ট্রের বহু সামরিক ও রাজনৈতিক কর্মকর্তারা এটা স্বীকার করেছেন যে, এখনো আল কায়দা গোষ্ঠী আফগানিস্তানে তৎপর রয়েছে এবং আফগানিস্তানে তারা ফের শক্তি সঞ্চয় করার চেষ্টা করছে। এ অবস্থায় মার্কিন সেনারা ও ন্যাটো বাহিনী গত ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানে অবস্থান করলেও উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো কেন এখনো তৎপর রয়েছে সেটাই আফগানিস্তানের জনগণ ও আন্তর্জাতিক সমাজের প্রশ্ন। এমনকি গত চার বছরে আফগানিস্তানে দায়েশ বা আইএস জঙ্গি সন্ত্রাসীদের অবস্থানও জোরদার হয়েছে।

এ প্রশ্নের জবাবে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, গত ২০ বছরে মার্কিন সেনারা আফগানিস্তানে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ তো নেয়নি বরং তাদেরকে সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে এই অঞ্চলের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের জন্য তাদেরকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা চালিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর যুক্তরাষ্ট্র তাদের বিরোধী সব রাষ্ট্রকে কব্জায় আনা এবং এ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের জন্য সন্ত্রাসীদেরকে ব্যবহার করে প্রক্সি যুদ্ধ শুরু করে।

খ্যাতনামা ফরাসি রাজনৈতিক বিশ্লেষক নিকোলা বভারয্‌ মনে করেন, ‘আফগানিস্তানের ব্যাপারে ভুল পদক্ষেপ নিয়ে মার্কিন সরকার সন্ত্রাসবাদ দমন করতেতো পারেনি বরং ওই দেশটিকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছে। এর পরিণতিতে ইউরোপসহ বিশ্বের বহু অঞ্চল ভয়ানক ক্ষতির শিকার হব’।

এ কারণে আন্তর্জাতিক সমাজকে ধোকা দিয়ে বিশ্বজনমতকে নিজের পক্ষে টানার জন্য যদিও মার্কিন সরকার সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা বলছে কিন্তু সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিন্টন স্বীকার করেছেন, ‘উগ্র জঙ্গি গোষ্ঠী তৈরিতে যুক্তরাষ্ট্রের হাত ছিল। অন্যদিকে পাকিস্তানের সাবেক নিহত প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোও স্বীকার করেছিলেন, তালেবান প্রতিষ্ঠা ও অন্যান্য উগ্র গোষ্ঠী সৃষ্টিতে ওয়াশিংটন ও ইসলামাবাদের হাত ছিল’।

যাইহোক, মার্কিন সাহায্য সমর্থন নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো গড়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ইরান ও চীনের সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টির দায়িত্ব পড়েছে ওই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর ওপর।

সম্প্রতি কাবুল বিমানবন্দরে সন্ত্রাসী হামলার পর মার্কিন সরকার নাঙ্গারহার প্রদেশে সন্ত্রাসীদের ওপর বিমান হামলার দাবি করেছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র এতো দ্রুত কিভাবে সন্ত্রাসীদের অবস্থান সনাক্ত করতে পারলো এবং সেখানে হামলা চালালো? এ কথাও বলা হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সন্ত্রাসীদের অবস্থান সম্পর্কে খুব ভালো করেই জানে। তাই যখনই তারা মার্কিন স্বার্থে আঘাত হানে তখনই মার্কিন সেনারা তাদের ওপর চড়াও হয়। যুক্তরাষ্ট্রেরে শান্তি ও যুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা সংস্থার বিশেষজ্ঞ স্টিভ কিলিয়ান মনে করেন, আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের ফলে সন্ত্রাসীরা নিরাপদে থাকলেও এতে কেবল ওই দেশটির সাধারণ মানুষজন ক্ষতির শিকার হয়েছে।

বাস্তবতা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র যখন কোনো সন্ত্রাসীদের মুখোমুখি হয় তখন তারা কেবল মার্কিন স্বার্থের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেয় এবং সেইভাবে পদক্ষেপ নেয়। এ কারণেই আল কায়দাকে দমনের কথা বলে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান দখল করলেও তারাতো দমন হয়নি এমনকি আল কায়দা আবারো সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

এ অবস্থায় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখন আফগানিস্তানকে সন্ত্রাসবাদের অভয়ারণ্যে পরিণত করতে পারে যাতে চীন ও রাশিয়াসহ এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের সঙ্গে আফগানিস্তানের ট্রাঞ্জিট রুট কখনোই নিরাপদ থাকতে না পারে এবং কেউ যাতে অবাধে ব্যবসা চালিয়ে যেতে না পারে। হপকিংস বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিভাগের অধ্যাপক ওয়ালি রেজা নাসের বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ওবামার শাসনের শেষের দিকে তালেবানের কাছ থেকে এ প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন যে তারা মার্কিন স্বার্থ ও নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করবে না এবং আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা সরিয়ে আনা হবে।

বাস্তবতা হচ্ছে, পাকিস্তানের ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা মাদ্রাসাগুলো উগ্রবাদ ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখছে। সৌদি আরবের ওয়াহাবি মতাদর্শে এ ধরনের হাজার হাজার মাদ্রাসা পাকিস্তানে গড়ে উঠেছে এবং সেখান থেকে উগ্র সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ঘটছে। এ অবস্থায় কাতারের রাজধানী দোহায় পাকিস্তান সমর্থিত আফগানিস্তানের তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে সমঝোতা হয়েছিল সেটাকে ওয়াশিংটন ও ইসলামাবাদের মধ্যকার সমঝোতা হিসেবে দেখা হলেও এ নিয়ে এখনো সন্দেহ রয়ে গেছে। কেননা সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বহুবার পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদের অভয়ারণ্য হিসেবে অভিহিত করে ওই দেশটিকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। তাই পাকিস্তানের মধ্যে এখনো ক্ষোভ রয়েছে।

যাইহোক, মার্কিনীরা লজ্জাজনকভাবে আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বিশ্বের কাছে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে তাদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার প্রমাণিত হয়েছে। কেননা তারা সন্ত্রাসবাদ দমনের কথা বলে আফগানিস্তান দখল করেছিল। সে কারণে মার্কিনীরা চলে গেলেও আফগানিস্তানের পরিস্থিতি ভবিষ্যতে কোনদিকে যায় সেটাই এখন দেখার বিষয় কেননা সন্ত্রাসীদেরকে ব্যবহারের নীতি থেকে যুক্তরাষ্ট্র এখনো সরে আসেনি

এ জাতীয় আরো সংবাদ

শান্তিতে নোবেল পেল জাপানের সংগঠন নিহন হিদাঙ্কিও

নূর নিউজ

যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করতে দেবে না পাকিস্তান

আনসারুল হক

কাজাখস্তানে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে বিক্ষোভ, নিহত বেড়ে ২২৫

নূর নিউজ