আল্লামা শায়খ সাজিদুর রহমান
ইসলাম শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম। ইসলাম মানবতা ও ভ্রাতৃত্বের ধর্ম। ইসলামে মানবের সকল শ্রেণীর মর্যাদা ও অবস্থান চিহ্নিত করা আছে। সেই মর্যাদা ও অবস্থানের বরখেলাপি করা ইসলামে গুরুতরভাবে নিষিদ্ধ।
ইসলামে অমুসলিমদেরও হক ও অধিকার নির্ধারিত আছে। রাষ্ট্রে বসবাসকারী অমুসলিম নাগরিকদের অধিকার ও অবস্থানের ব্যাপারে ইসলামে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে।
কোরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে, يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُم مِّن نَّفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً ۚ হে মানবজাতি, তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক ব্যক্তি থেকে এবং তারই থেকে তার স্ত্রীকে সৃষ্টি করেছেন। আর তাদের উভয় থেকে বহু নরনারী (পৃথিবীতে) ছড়িয়ে দিয়েছেন। (সূরা নিসা আয়াত-১)
এই আয়াত থেকে আমরা পাই, জগতের সকল মানব, ধর্মে, বর্ণে, রাষ্ট্রে, ও কর্মে সকলের যতই বৈচিত্র্য থাকুক না কেন, আমরা সবাই একই পিতা-মাতার সন্তান। মানুষ হিসেবে আমরা সবাই অভিন্ন। সুতরাং মানুষ হিসাবে একে অন্যকে মর্যাদা দেয়া, অন্যের অকল্যাণ থেকে বিরত থাকা, অন্যের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতায় বিঘ্নতা তৈরি না করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য।
রাষ্ট্রে বসবাসকারী অমুসলিমরা সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে কোনভাবেই যেন সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের থেকে জুলুমের শিকার না হয়, সেজন্য রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অতি প্রজ্ঞাপূর্ণ সুসমন্বিত নির্দেশনা দান করেছেন। আবু দাউদ শরীফের একটি বিখ্যাত হাদিস লক্ষ্য করুন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
ألا مَن ظلمَ مُعاهدًا، أوِ انتقصَهُ، أو كلَّفَهُ فوقَ طاقتِهِ، أو أخذَ منهُ شيئًا بغَيرِ طيبِ نفسٍ، فأَنا حَجيجُهُ يومَ القيامةِ
“যে ব্যক্তি কোন অমুসলিম নাগরিকের উপর জুলুম করে অথবা তার কোন ক্ষতি করে অথবা তার উপর সাধ্যাতীত বিষয়ের বোঝা চাপিয়ে দেয়, অথবা তার মনোতুষ্টি ছাড়া তার থেকে কোন কিছু ছিনিয়ে নেয়, কিয়ামতের দিন আমি তার বিরুদ্ধে অমুসলিমের পক্ষে প্রতিবাদকারী হব।” (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৩০৫১)
অথবা তার কোন ক্ষতি করে অথবা তার উপর সাধ্যাতীত বিষয়ের বোঝা চাপিয়ে দেয়, অথবা তার মনোতুষ্টি ছাড়া তার থেকে কোন কিছু ছিনিয়ে নেয়, কিয়ামতের দিন আমি তার বিরুদ্ধে অমুসলিমের পক্ষে প্রতিবাদকারী হব।” (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৩০৫১)
এবার সহীহ বুখারীর একটি হাদিস লক্ষ্য করুন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
من قَتَلَ مُعَاهَدًا لم يَرَحْ رَائحَةَ الجنة، وإن رِيْحَهَا تُوجَدُ من مَسِيرَة أربعين عامًا.”যে ব্যক্তি কোন (সংখ্যালঘু) অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করলো সে জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। অথচ জান্নাতের সুঘ্রাণ তো ৪০ বছরের দূরত্ব থেকেও পাওয়া যায়।” (সহীহ বুখারী, হাদিস ৩১৬৬)
দেখুন, কত সুস্পষ্টভাবে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংখ্যালঘুদের অধিকারের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন। সুতরাং সংখ্যালঘুদের উপর জুলুম করা, তাদের অধিকার খর্ব করা, তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
হিজরতের পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনা মুনাওয়ারায় একটি শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে মদিনায় বসবাসরত অমুসলিমদের সাথেও চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলেন।
যেই চুক্তিটি ‘মদিনা সনদ’ নামে প্রসিদ্ধ। মদিনা সনদের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারা ছিল, নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে বসবাসকারী সকল নাগরিকরা, যে যেই ধর্মের অনুসারী হোক না কেন, সকল নাগরিক জান-মালের নিরাপত্তা পাবে। একটি আদর্শ শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্রের জন্য পরস্পরের সম্প্রীতি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা মদিনা সনদ থেকে সুস্পষ্ট।
আবহমান কাল থেকেই এদেশের মুসলমানরা শান্তিপ্রিয়, ধর্মপ্রাণ। এদেশের মুসলমানরা সবসময়ই সংখ্যালঘুদের সঙ্গে সম্প্রীতি ও সহমর্মিতার সম্পর্ক বজায় রেখে এসেছে। এটাই আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য এবং ইসলামেরও আদর্শ। সম্প্রীতি ও সহমর্মিতার এই ঐতিহ্য এবং ইসলামের এই মহিমান্বিত আদর্শ ধরে রাখার বিষয়ে আমরা গোটা দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: কো চেয়ারম্যান, আল হাইয়াতুল উলিয়া