ভারতবর্ষের প্রথম মসজিদ; যা মহানবী (সা:) জীবিত থাকাকালেই নির্মিত হয়

স্বপ্ন দেখে রাজা খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। এসময় মুজিরিস বন্দরে আরব বণিকদের একটি জাহাজ ভেড়ে। জাহাজটি সিলন (শ্রীলঙ্কা) যাওয়ার পথে সেখানে নোঙ্গর করেছিল। জাহাজে ছিলেন শেখ সাহিরুদ্দিন বিন বাকিউদ্দিন আল মাদানি। তার নেতৃত্বে একদল আরব রাজধানীতে আসেন এবং রাজার সাথে সাক্ষাত করেন। রাজা বণিকদের কাছে তার স্বপ্নের বর্ণনা দেন, এবং তখন জানতে পেরে খুবই বিস্মিত হন যে এটি ছিল ইসলামের নবীর করা একটি অলৌকিক দৃষ্টান্ত।

কেরালার কোদুঙ্গাল্লুর জেলার চেরামান জুমা মসজিদ। ছবি: মনোজ রামাচন্দ্রন/ গালফ নিউজ

চিরসবুজের এক রাজ্য ভারতের কেরালা। এই প্রদেশের কোদুঙ্গাল্লুর জেলার চেরামান জুমা মসজিদ ঘুরেফিরে দেখা কোনো অংশেই যেন ‘টাইম ট্রাভেল’ করে অতীতের ফিরে যাওয়ার চেয়ে কম কিছু নয়। ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে তৈরি এ মসজিদ ভারতের প্রথম এবং সমগ্র উপমহাদেশের প্রাচীনতম।

কেরালার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অংশ এ মসজিদ, একইসাথে ধারণ করছে প্রাচীন ভারতে বহু সংস্কৃতি ও ধর্মের মিলনমেলা।

এই মসজিদ যখন তৈরি হয় তখনও জীবিত ছিলেন ইসলামের শেষ নবী হজরত মোহাম্মদ (সা:), সে সময়েই সুদূর কেরালায় এটি কীভাবে নির্মিত হলো?- সে প্রশ্নের উদয় হওয়াটাই স্বাভাবিক।

ইতিহাসে ফিরে তাকালে দেখা যায়, প্রাচীন বন্দর মুজিরিসের কাছেই কোদুঙ্গাল্লুর জেলা। এ বন্দর ছিল তৎকালে বিশ্ববাণিজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। স্থানীয় চেরা রাজ্যের ব্যবসায়ীরা এখানে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বণিকদের সাথে হরপ্পা সভ্যতার সময়কাল থেকে গোলমরিচ, আদা, দামি কাঠ ও কাপড়ের ব্যবসা করতেন। এজন্য মিশরের ফারাও দ্বিতীয় রামেসিসের মমিতে ঠাসা অবস্থায় পাওয়া গেছে ভারতের কালো গোলমরিচ। দামি ও মজবুত ভারতীয় কাঠ এ বন্দর দিয়েই পৌঁছে যায় প্রাচীন মেসোপটেমীয় সভ্যতায়। সেখানে সম্রাট নেবুচাদনেজারের প্রাসাদ এবং উর নগরীর বিখ্যাত সুমেরীয় জিগারুট মন্দিরের স্থাপত্যে পাওয়া গেছে দক্ষিণ ভারত থেকে আসা কাঠের ব্যবহার।

ষষ্ঠ শতকে আরবরা ছিল সুদক্ষ সমুদ্র অভিযাত্রী ও বণিক। তারা অনেক বাণিজ্যপথ আবিষ্কার করেছিলেন। কেরালার চেরা রাজ্যের রাজাদের সাথেও তারা ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। এই বণিকদের মাধ্যমেই মক্কা নগরীর অধিবাসী নবী মোহাম্মদ (সা:) এবং ইসলামের কথা পুরো মালাবার অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগেনি।


চেরামান জুমা মসজিদের অভ্যন্তরে নামাজের জায়গা। ছবি: মনোজ রামাচন্দ্রন/ গালফ নিউজ


স্বপ্ন দেখে চমকিত:

হাদিসে উল্লেখ আছে, নবী মোহাম্মদ (সা:) মুজেযা বা আল্লাহর দেওয়া ঐশ্বরিক ক্ষমতার প্রমাণ হিসেবে একবার অঙ্গুলিনির্দেশে চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত করেছিলেন। সেকালের আরব উপদ্বীপের অনেক ব্যক্তি এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন- এমন বর্ণনাও মেলে। সে সময় কেরালার রাজা ছিলেন চেরা বংশের রাজা চেরামান পেরুমাল রামা ভার্মা কুলাশেখারা। তিনি এই অত্যাশ্চর্য ঘটনা স্বপ্নে দেখেন। কিন্তু ঘুম ভেঙে বুঝে উঠতে পারছিলেন না- স্বপ্নে আসলে তিনি কী দেখলেন? ডাক পড়লো রাজদরবারের জ্যোতিষীদের, কিন্তু তারাও রাজাকে এর সন্তোষজনক কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারলেন না।

এদিকে রাজা খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। এসময় মুজিরিস বন্দরে আরব বণিকদের একটি জাহাজ ভেড়ে। জাহাজটি সিলন (শ্রীলঙ্কা) যাওয়ার পথে সেখানে নোঙ্গর করেছিল। জাহাজে ছিলেন শেখ সাহিরুদ্দিন বিন বাকিউদ্দিন আল মাদানি। তার নেতৃত্বে একদল আরব রাজধানীতে আসেন এবং রাজার সাথে সাক্ষাত করেন। রাজা বণিকদের কাছে তার স্বপ্নের বর্ণনা দেন, এবং তখন জানতে পেরে খুবই বিস্মিত হন যে এটি ছিল ইসলামের নবীর করা একটি অলৌকিক দৃষ্টান্ত।

‘মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহ’ গ্রস্থে এ ঘটনার উল্লেখ করেছেন হাদিস ও ইসলামিক আইন বিশেষজ্ঞ এম. হামিদুল্লাহ। এর আরো উল্লেখ রয়েছে উইলিয়াম লোগানের বই ‘মালাবার ম্যানুয়াল’; আহমেদ জইনুদ্বীন মাখতুমের ‘তহফাতহুল মুজাহেদিন; এবং বালাকৃষ্ণ পিল্লাইয়ের ‘হিস্টোরি অব কেরালা: অ্যান ইন্ট্রোডাকশন’ গ্রন্থে।

শেখ আল মাদানির দেওয়া স্বপ্নের ব্যাখ্যায় বিশ্বাস করে রাজা তার সাম্রাজ্যকে তিনভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেন, এবং প্রত্যেক প্রদেশের শাসনভার তার পুত্র ও ভ্রাতুষ্পুত্রদের হাতে তুলে দিয়ে নিজে আরবে গিয়ে নবী (সা:) এর সাথে সাক্ষাৎ করে তারপর ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।


সংস্কার কাজের সময় মসজিদের স্তম্ভে আরবিতে কিছু লেখাও আবিষ্কৃত হয়েছে। ছবি: মনোজ রামাচন্দ্রন/ গালফ নিউজ


ঐতিহাসিক সাক্ষাৎ:

পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী, এরপর ওই আরব বণিকেরা সিলন চলে যান। তারা ফেরার পথে আবার কেরালা আসেন। এবার তাদের সাথে আরব দেশের দিকে যাত্রা করেন স্বয়ং রাজা চেরামান। কথিত আছে তারা যখন শেহর মুকল্লায় পৌঁছান তখনই নবী মোহাম্মদ (সাঃ) এর সাক্ষাৎ পান রাজা। ইমাম বুখারি এবং নবীর একজন গুরুত্বপূর্ণ সাহাবী আবু সাইদ খুদরি (রাঃ) ঐতিহাসিক এ সাক্ষাতের কথা হাদিসে উল্লেখ করেছেন।

হাদিসে বলা হয়েছে, “ভারত থেকে আসা এক রাজা নবীকে আদার আচার উপহার দেন। নবী এটি সকল সাহাবীর মাঝে ভাগ করে দেন। ভাগাভাগিতে আমিও এক টুকরো পাই।”

এরপর নবীর সামনে নিজের ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন রাজা চেরামান। পরে তিনি হজ সম্পন্ন করেন। নবীর নির্দেশ অনুসারে, মালিক বিন দিনারের নেতৃত্বে একদল সাহাবী কেরালায় ইসলাম প্রচার করতে রাজা চেরামানের ফিরতি যাত্রায় সফরসঙ্গী হন। যাত্রাপথে রাজা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। মৃত্যুর আগে তিনি তার পুত্রদের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লেখেন, সেখানে মালিক বিন দিনার ও তার সঙ্গীদের স্বাগত জানাতে এবং প্রয়োজনীয় সকল সহায়তা দিতে তাদের প্রতি নির্দেশ দেন। রাজা চেরামান এর কিছু পরেই মারা যান। তাকে বর্তমান ওমানের জাফার বা বর্তমান সালালাহ এলাকায় দাফন করা হয়।

মুজিরিসে পৌঁছানোর পর স্থানীয় শাসকের সাথে দেখা করেন মালিক বিন দিনার এবং তার হাতে প্রয়াত রাজার চিঠি তুলে দেন। চিঠি পড়ে শাসক ইসলাম প্রচারে দরকারি সব সহযোগিতা দেওয়ার ব্যবস্থা নেন। ধারণা করা হয়, তখনই এ মসজিদ নির্মিত হয়।

এই ঘটনার কথাও উল্লেখ করেছেন শেখ আহমেদ জইনুদ্দিন মাখদুম বিন শেখ মোহাম্মদ আল গাজ্জালী।

কাহিনির এ সংস্করণ কি সত্যি?

‘চেরামান জুমা মসজিদ: চরিত্রাওম, সংস্কারম’ (চেরামান জুমা মসজিদ: ইতিহাস ও সংস্কৃতি) বইয়ের লেখক ও গবেষক অঞ্জলী মোহন গালফ নিউজকে বলেন, “বিরোধীমত রয়েছে যে রাজা চেরামানের ইসলাম গ্রহণের ঘটনা পুরোটাই একটি ধর্ম-বিশ্বাস প্রসূত কাহিনি। সমালোচকদের অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, এত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কেন আর বিরুনির ভ্রমণবৃত্তান্ত ‘তাহিল মাল-ই- হিন্দ মিন মাকুলাহ মাকবুলাহ ফি আল- আকল আও মারধুল্লাহ’তে উল্লেখ নেই? আসলে এম হামিদুল্লাহ, উইলিয়াম লোগান, আহমেদ জইনুদ্দিন মাখতুম ও বালাকৃষ্ণ পিল্লাই যে কাহিনিটি বর্ণনা করেছেন তার কোনো বিকল্প ঘটনার উল্লেখও কোথাও পাওয়া যায়নি।

কেরালার ঐতিহ্যের করিডর

কেরালার পর্যটনমন্ত্রী পিএ মোহাম্মদ রিয়াজ গালফ নিউজকে বলেন, “কেরালা সবসময় অতিথিদের উষ্ণ অভ্যর্থনা, ভালোবাসা ও সম্মানের সাথে গ্রহণ করেছে। এখানকার মানুষ আজো সেই সংস্কৃতি মেনে চলে। আমরা অতিথিদের জাতপাত বা জাতীয়তা বিচার না করেই সাদর অভ্যর্থনা জানাই। মালায়লী জনতা বিশাল হৃদয়ের অধিকারী, তারা সকল সংস্কৃতি, রুচি ও বিশ্বাসকে গ্রহণ করতে জানে।”

স্থানীয় প্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলিকে রক্ষা করতে রাজ্য সরকার মুজিরিস হেরিটেজ প্রকল্প নিয়েছে। এর আওতায় বর্তমানে চেরামান জুমা মসজিদেরও সংস্কারের কাজ চলছে, যার মাধ্যমে এটির কাঠামোগত দৃঢ়তা বাড়ানো হচ্ছে।

রিয়াজ জানান, “সরকার মুজিরিস হেরিটেজ প্রকল্পকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বাস্তবায়ন করছে। ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, এই বন্দর দিয়ে প্রাচীন রোম ও পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর সাথে খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম থেকে ৫ম শতক পর্যন্ত সক্রিয় বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল কেরালার। ইতিহাসের এসব অমূল্য সম্পদ সংরক্ষণে তরুণ সমাজকেও যুক্ত হতে হবে, যা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য লাভজনক এক বিনিয়োগ হবে।”

এ জাতীয় আরো সংবাদ

বছরের শুরুতে যে দোয়া বেশি পড়বেন

নূর নিউজ

ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের পক্ষে জাতিসংঘে প্রস্তাব পাস

নূর নিউজ

রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিববুল্লাকে গুলি করে হত্যা

নূর নিউজ