আমরা জানি, পানি পান করা ছাড়া কোনো প্রাণীর বেঁচে থাকা অসম্ভব। আবার অনেক জীব নির্দিষ্ট উৎসের পানি পান করে থাকে। এদের মধ্যে চাতক পাখি অন্যতম। যারা বৃষ্টির পানি ছাড়া অন্য কোনো উৎসের পানি পান করে না।
এরা বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করে। চাতককে খাঁচায় পুষেও এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে কেউ কেউ বলে থাকেন, অন্য কোনো পানি উপর থেকে ছিটিয়ে বা স্প্রে করে দিলে চাতক বৃষ্টির পানি ভেবে তা পান করে থাকে!
চাতক পাখির বৈশিষ্ট্য :কালোরঙা এই পাখির লেজ লম্বা। লেজসহ, পাখিটি দেখতে অনেকটা ময়নার মতো। চাতকের বৈজ্ঞানিক নাম ক্ল্যামাটর জ্যাকোবিনাস (Clamator Jacobins)। চাতক পাখির আয়ু ২০ বছর। এই পাখি মৃত্যুর সময় পিঠ মাটিতে ঠেকিয়ে, পাদুটো ওপরের দিকে তুলে, ঠোঁট হাঁ করে এবং চোখ খোলা অবস্থায় আকাশের দিকে তাকিয়ে মারা যায়!
চাতককে নিয়ে প্রচলিত ধারণা :বাংলাদেশে চার প্রজাতির পাখিকে চাতক বলে। যতদূর জানা যায় এটি পাকড়া, পাপিয়া বা বুলবুলি পাখিদের অন্তর্গত একটি পাখি। পাকড়া পাপিয়াও এক ধরনের চাতক পাখি। এ পাখি বৃষ্টির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁ করে থাকে। বৃষ্টি এলে মুখের মধ্যে ফোঁটা পড়ে। চাতক সেই পানি খায়। বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করতে করতে একসময় গলা শুকিয়ে গরম হয়ে যায়। চাতক তখন বৃষ্টির জন্য চিৎকার করতে থাকে। তবু বৃষ্টি হয় না! তখন চাতকের গলা দিয়ে আগুনের ফুলকি বের হয়। পুরোটাই একটা পুরনো গল্প!
পাকড়া পাপিয়া দেশের দুর্লভ পাখিগুলোর একটি। এরা পরিযায়ী। বছরের বেশির ভাগ সময় এদেশেই থাকে। শীতকালে চলে যায় আফ্রিকায়। ফিরে আসে শীত শেষে। আগে যেখানে থাকত আবার সেখানে ফিরে যায়। এরা গাছের উঁচু ডালে একা একা বসে থাকে। বৈদ্যুতিক তারেও বসতে দেখা যায়। মাঝে মাঝে একজোড়া পাখি এক সঙ্গে দেখা যায়। এরা ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে খাবার খায়। শুঁয়োপোকা, উই, পিঁপড়া, ছারপোকা এদের প্রধান খাদ্য।
এই পাখিটি সাধারণত ফড়িং, পোকা বিশেষ করে শুঁয়োপোকা খেতে খুব পছন্দ করে। লোককথা অনুসারে এদের মাথায় নাকি একটা ঠোঁট থাকে, যা দিয়ে এরা বৃষ্টির পানি পান করে! পাকড়া পাপিয়ার চেহারায় রাজকীয় একটা ছাপ আছে। মাথায় শিংয়ের মতো ঝুঁটি। পিঠ, পাখা ও লেজ কালো। দুই পাখায় একটা করে ছোট সাদা পট্টি। লেজের আগার দিকের কিনার সাদা। গলা, বুক ও পেট সাদা। মাথা, ঘাড়, লেজ, ঝুঁটি ও ঠোঁট কালো, পা কালো। তবে পায়ে সাদা পালকের আবরণে ঢাকা।
চাতক ‘পিউ…পিউ…’ স্বরে ডেকে থাকে। এটি কোকিল গোত্রের পাখি। বাসা বাঁধে না। ডিমে তা দেয় না। ছানাও লালন-পালন করে না। বসন্তকালে ডিম পাড়ে ছাতারে পাখির বাসায়। ছাতারে নিজের ডিম মনে করে সেটি তা দেয়! ছানা বড় করে। একসময় ছাতারে বুঝতে পারে এই ছানা তার নয়! তখন ঠুকরে পাপিয়ার ছানাগুলোকে তাড়িয়ে দেয়। ততদিনে শিশু চাতক পাখি উড়তে শিখে যায়!
চাতক পাখি বর্ষা ডেকে আনে!
বর্ষার ঠিক আগে এই পাখিটির আগমন ঘটে! তাই ভাবা হয় এই পাখিটি বর্ষাকে ডেকে নিয়ে আসে! ওড়ার সময় এদের ডানার ও লেজের সাদা অংশ সহজেই দেখা যায়। অপরিণত পাখির বুকের রং সাদা হয় না বরং কিছুটা কমলা বর্ণের হয়ে থাকে। মহাকবি কালিদাসের ‘মেঘদূতে’ চাতক পাখির উল্লেখ পাওয়া যায়।
চাতকের বিস্তৃতি :চাতক পাখি বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে দেখতে পাওয়া যায়। ভারতের উত্তরাখণ্ডে চাতক পাখির দেখা মেলে। উত্তরাখণ্ডের গাড়ওয়ালে একে ‘চোলী’ বলা হয়। গাড়ওয়ালের লোকেদের মতে, চাতক বেশির ভাগ সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। চাতককে মাগওয়া ও মাড়োয়ারি ভাষায় পাপিয়াও বলা হয়ে থাকে। চাতকের বিচরণ ক্ষেত্র : আফ্রিকার দক্ষিণ থেকে তাঞ্জানিয়া ও জাম্বিয়া পর্যন্ত এবং উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে নেপাল, বাংলাদেশ, মিয়ানমার পর্যন্ত বিস্তৃত।
অর্থাৎ বলা যায়, সারা পৃথিবীর বিশাল এলাকা জুড়ে এদের বসবাস। আর আয়তনে প্রায় ৩৬ লাখ ৮০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে এদের আবাস।
চাতক নিয়ে লোকবিশ্বাস :অনেক সময় দেখা যায় বৃষ্টির মৌসুম ছাড়াই শীতকালে বা অসময়ে আকাশে কোনোরকম মেঘ ছাড়াই হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি নামে। এরকম হঠাৎ বৃষ্টি হলে গ্রামের মুরুব্বীরা বলেন, চাতক পাখির আর্তনাদ আর প্রার্থনায় মেঘদেবতা বা মিকাইল ফেরেশতা বৃষ্টি দিতে বাধ্য হয়েছে। সেই বিশ্বাস থেকেই আগের দিনে গ্রামবাংলায় চৈত্র-বৈশাখে অনাবৃষ্টি আর খরা দেখা দিলে, খড়কুটো দিয়ে প্রতীকী চাতক পাখি বা চাতকমূর্তি বানিয়ে; সেটিকে খোলা মাঠে আকাশের দিকে অনেক উঁচু করে রাখা হতো।
চাতক নিয়ে প্রচলিত রূপকথা :চাতক পাখিকে নিয়ে একটি লোককাহিনি প্রচলিত আছে। কাহিনিটি এমন- মৃত্যুপথযাত্রী এক মা তার কিশোর ছেলের কাছে পানি পান করতে চাইলেন। কিন্তু মায়ের আকুতি ভুলে কিশোর ছেলেটি খেলায় মত্ত হয়ে রইল। ইতোমধ্যে মা পানির তৃষ্ণায় কাতর হয়ে মারা গেলেন। ছেলে বাড়ি ফিরে দেখল তার মা মারা গেছে। ছেলেটি কান্নায় ভেঙে পড়ল এবং অনুশোচনায় পড়ে গেল।
এরপর পানি, পানি, করে চিৎকার করতে করতে পাড়া-মহল্লায় ঘুরতে লাগল। এমনকি মায়ের আকুতিভরে চাওয়া পানি পৌঁছে দিতে স্বর্গে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করতে চাইল! কিন্তু সেটা চাইলেই তো সম্ভব না! স্বর্গে যেতে বহু দূরের পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য ছেলেটি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করল, তাকে যেন পাখি বানিয়ে দেওয়া হয়; যাতে সে মায়ের কাছে যেতে পারে। আল্লাহ ছেলেটির মিনতিভরে চাওয়া কবুল করলেন। এরপর ছেলেটি পাখি হয়ে গেল। ছেলেটি মনে মনে আরও প্রতিজ্ঞা করল, মায়ের মুখে পানি না দিয়ে সে এক ফোঁটা পানিও পান করবে না। আর যদি তৃষ্ণায় পানি পান করতেই হয়, তাহলে বৃষ্টির পানি ছাড়া পান করবে না! এই কাহিনি নিয়ে লোকবিশ্বাসটা এরকম যে, ওই কিশোর ছেলেটি আজও পাখি হয়ে উড়ে উড়ে আল্লাহর কাছে পানির জন্য প্রার্থনা করে।