ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মাদ এলোরে দুনিয়ায়

প্রেমের নবি মুহাম্মাদ (সা.)। নুরের নবি তিনি। তিনি সুরের নবি। জাহিলিয়াতের ঘোর অমানিশায় তিনি আলোর ফুল হয়ে ফুটে ছিলেন। এসেছিলেন সত্য, সুন্দর ও শান্তির বার্তা নিয়ে। সাম্য, সম্প্রীতি, সহিষ্ণুতা, ভ্রাতৃত্ববোধ সর্বোপরি মানবাধিকারের কালজয়ী যে সবক তিনি জগৎবাসীকে দিয়েছেন তাতে রয়েছে- সব মানুষের কল্যাণ ও মুক্তি। তার জীবনাদর্শের নানা দিক নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন-তোফায়েল গাজালি

বংশ পরিচয়

বাবার নাম আব্দুল্লাহ, দাদা আব্দুল মুত্তালিব। প্রপিতামহ হাশেম। হাশেমের দিকে সম্পর্কযুক্ত করে নবিজির বংশ হাশেমি বংশ হিসাবে পরিচিত যা আদনান হয়ে সর্বসম্মিতক্রমে হজরত ইসমাইল (আ.) পর্যন্ত পৌঁছে। এতে সন্দেহ নেই যে, রাসূল (সা.) হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর বংশধর।

জন্ম ও শৈশব

হজরত মুহাম্মাদ (সা.) ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে, আরবের মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মের ৬ মাস আগে বাবা আব্দুল্লাহ মদিনায় মৃত্যুবরণ করেন। আরবের প্রচলন অনুযায়ী রাসূল (সা.) কে শহরের বাইরে বনি সাদ গোত্রে দুধপান ও লালন পালনের জন্য পাঠানো হয়। পাঁচ বছর পর্যন্ত তিনি সেখানে হালিমা সাদিয়া (রা.) স্নেহ মমতায় বেড়ে ওঠেন।

মা আমেনার ইন্তেকাল

শিশু মুহাম্মাদ-এর বয়স ছয় বছর হলে মা আমেনা ছোট্ট মুহাম্মাদকে সঙ্গে নিয়ে স্বামী আব্দুল্লাহর কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদিনায় যান। মদিনা থেকে ফেরার পথে মক্কা ও মদিনার মাঝে অবস্থিত আবহাওয়া নামক স্থানে তিনি ইন্তেকাল করেন।

দাদা ও চাচার তত্ত্বাবধান

বাবা-মার মৃত্যুর পর দাদা আব্দুল মুত্তালিব তার লালন পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আট বছর বয়সে দাদার মৃত্যুর পর চাচা আবু তালিব তার দায়িত্ব নেন। তিনি চাচার বকরি দেখাশোনা ও ব্যবসার কাজে সহযোগিতা করতেন।

বিয়ে

পঁচিশ বছর বয়সে খাদিজা (রা.) কে বিয়ে করেন। বনু হাশেম ও কুরাইশের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে বিশটি উট মহর ধার্য করে তাদের বিয়ে হয়। খাদিজাই নবিজির প্রথম স্ত্রী। তার জীবদ্দশায় নবিজি অন্য কাউকে বিয়ে করেননি।

সন্তানসন্ততি

একমাত্র ইবরাহিম ছাড়া নবিজির সব সন্তান খাদিজা (রা.)-এর গর্ভে জন্ম নিয়েছেন। কাসেম প্রথম সন্তান। পরে যয়নব, রুকাইয়া, উম্মে কুলসুম, ফাতেমা ও আব্দুল্লাহ (রা.)-এর জন্ম হয়। তার ছেলেরা শৈশবে মারা যান। ফাতেমা (রা.) ছাড়া সবাই নবিজির জীবদ্দশায় মারা যান। নবিজির ইন্তেকালের ছয় মাস পর ফাতেমা (রা.) মৃত্যুবরণ করেন।

খোদায়ী প্রত্যাদেশ

হেরা গুহায় সাধনার তৃতীয় বছর রমজান মাসে যখন তার বয়স চল্লিশ পেরিয়ে একচল্লিশ চলছিল-তিনি গুহার ভেতরে আল্লাহর ধ্যানে নিমগ্ন ছিলেন। জিবরাইল (আ.) আল্লাহর পক্ষ থেকে এসে তাকে নবুওয়াতের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেন। প্রথম সূরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত তার প্রতি নাজিল হয়। জিবারাইল (আ.) এসে বলেন-পড়ো। তিনি জবাব দেন-আমি পড়তে জানি না।

রাসূল (সা.) বলেন, আমার এ কথার জবাবে ফেরেশতা আমাকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরেন। এত জোরে জড়িয়ে ধরেন যে, আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। এর পর আমাকে ছেড়ে দিয়ে আবার বলেন-পড়ো। আগের মতোই উত্তর দিলাম-আমি তো পড়তে জানি না। ফেরেশতা আমাকে দ্বিতীয়বার শক্তভাবে আঁকড়ে ধরলেন। এবারও আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। আমাকে আবার বললেন, পড়ো। আমি বললাম-আমি পড়তে জানি না।

ফেরেশতা আমাকে তৃতীয়বার কঠিনভাবে জাপটে ধরলেন এবং ছেড়ে দিয়ে বললেন-‘পাঠ করুন আপনার পালনকর্তার নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তা মহাদয়ালু, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।’ (সূরা আলাক ১-৫)।

গোপনে ইসলাম প্রচার

খোদায়ী প্রত্যাদেশ তথা ওহি নাজিল হওয়ার পর রাসূল (সা.) গোপনে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। প্রথম আপন পরিবারের লোকদের ইসলামের দাওয়াত দেন। প্রথম খাদিজা (রা.) তার দাওয়াতে ইসলাম গ্রহণ করেন। পুরুষদের মধ্যে প্রথম আবু বকর (রা.), ছোটদের মধ্যে আলী ইবনে (রা.) এবং ক্রীতদাসদের মধ্যে যায়েদ ইবনে হারেসা (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন।

প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার

আল্লাহ প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের আদেশ দিলে নবিজি (সা.) তাঁর পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনকে সাফা পাহাড়ের পাদদেশে একত্রিত করেন। এরপর তাদের মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করে এক আল্লাহর ইবাদত করতে আহ্বান করেন। এ কথা শুনে তার চাচা আব– লাহাব বলে-‘তোমার ধ্বংস হোক, এ জন্যই কি আমাদের একত্রিত করেছ?’ এর পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহতায়ালা সূরা লাহাব অবতীর্ণ করেন-‘আবু লাহাবের দুহাত ধ্বংস হোক এবং ধ্বংস হোক সে নিজে। কোনো কাজে আসেনি তার ধনসম্পদ ও যা সে উপার্জন করেছে। সত্বরই সে প্রবেশ করবে লেলিহান অগ্নিতে এবং তার স্ত্রীও, যে ইন্ধন বহন করে, তার গলদেশে খর্জুরের রশি নিয়ে।’ (সূরা লাহাব : ১-৫)।

আবিসিনিয়ায় হিজরত

কালেমার দাওয়াতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ইমানদার সাহাবিদের প্রতি অবিশ্বাসীদের নির্যাতন ও নিষ্পেষণ ক্রমেই বেড়ে চলছে। এমতাবস্থায় রাসূল (সা.) সাহাবিদের আবিসিনিয়ায় হিজরত করার নির্দেশ দেন। আবিসিনিয়ার বাদশা নাজ্জাশী ন্যায়পরায়ণ ও দয়ালু ছিলেন। এ জন্য আবিসিনিয়াকে হিজরতের জন্য মনোনীত করা হয়। বাদশা নাজ্জাশী ঈসা (আ.)-এর অনুসারী ছিলেন। নবুওয়াতের পঞ্চম বছর প্রথম হিজরতকারী মুসলমানদের কাফেলার সদস্য ছিলেন দশজন পুরুষ ও চারজন মহিলা। কিছুদিন পর আরও একটি দল তাদের সঙ্গে মিলিত হয়। তারা নারী, পুরুষ ও শিশুসহ মোট ছিলেন প্রায় একশজন। আবিসিনিয়ায় বাদশা নাজ্জাশী তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেন এবং নিরাপদে বসবাসের অনুমতি দেন।

তায়েফের পথে প্রান্তরে

নবুওয়াতের দশম বছর রাসূল (সা.)-এর চাচা আবু তালিব ও আম্মাজান খাদিজাতুল কুবরা (রা.)-এর মৃত্যুকে কুরাইশরা সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করল। তার ওপর নানা রকমের নির্যাতনের মাত্রা আগের চেয়ে বহুগুণে বাড়িয়ে দিল। এ কঠিন পরিস্থিতিতে সহযোগিতা ও নিরাপত্তার আশায় তিনি তায়েফ চলে যান। সেখানে উপহাস, দুর্ব্যবহার ও দুঃসহ নির্যাতন ছাড়া আর কিছুই পেলেন না। তায়েফের লোকদের পাথরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত নবিজি (সা.) বিমূর্ষ হয়ে মক্কায় ফিরে এলেন।

মক্কা ছেড়ে মদিনায়

মক্কার কাফেররা রাসূল (সা.) কে আমানুষিক নির্যাতনের পরও যখন ইসলাম প্রচার থেকে নিবৃত্ত করতে পারছিল না তখন তারা একদিন সর্বশেষ নীতি নির্ধারণের উদ্দেশ্যে ‘নদওয়া’ গৃহে সব গোত্রপতির বৈঠক আহ্বান করে। বৈঠকে কেউ পরামর্শ দিল, ‘মুহাম্মাদ (সা.)-কে শৃঙ্খলিত করে কোনো ঘরের মধ্যে বন্দি করে রাখা উচিত।’ কেউ বলল, ‘তাকে নির্বাসিত করা হোক।’ সবশেষে আবু জাহেল ভিন্ন রকম পরামর্শ দিল, সে বলল-‘নানা কৌশল করে আমরা মুহাম্মাদকে আটকাতে চেয়েছি। কিন্তু সম্ভব হলো না। বরং তার কাজ বেড়েই চলছে। তাই মুহাম্মাদকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়াই সবচেয়ে উচিত হবে। ’

সমবেত সবাই এ সিদ্ধান্তের ওপর সমর্থন ব্যক্ত করে। তারা জঘন্যতম কাজটা সম্পন্ন করতে প্রত্যেক গোত্রের শক্তিশালী যুবকদের নির্বাচন করে। এরপর ঘোষণা করে, মুহাম্মাদকে যে জীবিত অথবা মৃত ‘নদওয়া’ গৃহে হাজির করতে পারবে, তাকে ১০০ উট পুরস্কার দেওয়া হবে। মক্কার সব গোত্রের শক্তিশালী যুবকরা একত্রিত হয়ে শপথ নেয়, সেদিন রাতেই মুহাম্মাদ (সা.)-এর বাড়ি ঘেরাও করা হবে। সেদিনই তাকে চিরতরে শেষ করে দেওয়া হবে।

রাতেই আল্লাহতায়ালা ওহির মাধ্যমে এ চক্রান্তের কথা তার রাসূলকে জানিয়ে দেন। প্রিয় নবি (সা.)কে তিনি হিজরতের আদেশ দিয়ে বলেন, ‘হে নবি! মক্কার মানুষ আপনাকে চায় না। অন্যদিকে মদিনার মানুষ আপনার জন্য সীমাহীন আগ্রহে প্রতীক্ষা করছেন। আপনি হিজরত করে মদিনায় চলে যান।’

হিজরতের নির্দেশ পাওয়া মাত্রই প্রিয়নবি (সা.) নিজের ঘরে আপন চাচাতো ভাই হজরত আলী (রা.)কে রাখেন। এরপর প্রিয়সঙ্গী আবু বকর (রা.)কে নিয়ে মহানবি (সা.) মদিনার উদ্দেশে রওনা হন। রওনা হওয়ার মুহূর্তে বাইতুল্লাহর দিকে করুণ দৃষ্টিতে নবিজি বলেন, ‘হে মক্কা! খোদার কসম, তুমি আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় শহর, আমার প্রতিপালকের কাছেও বেশি পছন্দের শহর তুমি। যদি তোমার অধিবাসীরা আমাকে বের করে না দিত, আমি কখনো বের হতাম না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৯২৫)।

মহানবি (সা.) আল্লাহতায়ালার আদেশে ২৭ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মোতাবেক ১২ রবিউল আওয়াল মদিনা মুনাওয়ারায় পৌঁছান। তিনি মদিনায় পৌঁছে ইসলামের প্রথম মসজিদ ‘মসজিদে কুবা’ নির্মাণ করেন।

বদর যুদ্ধ

মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাফেরদের অত্যাচারের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে গেলে আল্লাহ রাসূল (সা.)কে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেন। আল্লাহ বলেন, যারা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয় তোমরা আল্লাহর পথে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর। অবশ্য কারও প্রতি বাড়াবাড়ি করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না। (সূরা বাকারাহ-১৯০)।

প্রিয় নবি (সা.) পরামর্শ করে মুহাজির ও আনসারদের নিয়ে গঠিত প্রায় ৩১৩ জনের একটি সেনাদল নিয়ে মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার লক্ষ্যে বের হন। হিজরি দ্বিতীয় সনের ১৭ রামজান বদর নামক স্থানে উভয় দল মুখোমুখি হয় এবং সেখানেই বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে মুসলমানদের মহাবিজয় অর্জিত হয় এবং অনেক গনিমতের সম্পদ লাভ হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের মাঝে সেগুলো বণ্টন করে দেন। এ যুদ্ধে মোট ৭০ জন মুশরিক নিহত হয় এবং ৭০ জন বন্দি হয় আর ১৪ জন মুসলমান শাহাদতবরণ করেন।

উহুদ যুদ্ধ

বদর যুদ্ধে কুরাইশদের শোচনীয় পরাজয়ের পর কাফেররা পূর্ণ এক বছরব্যাপী সৈন্য ও সম্পদ সঞ্চয় এবং প্রতিবেশী গোত্রীয় মিত্রদেরকে সহায়তা প্রদানের আহ্বানসহ জোর প্রস্তুতি গ্রহণ করে। আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে তিন হাজারের অধিক সৈন্যের একটি বিশাল বাহিনী গঠন করে মুসলমানদের ওপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়।

নবিজির কাছে কুরাইশদের আক্রমণের খবর পৌঁছলে তিনি মুহাজির ও আনসার নিয়ে গঠিত এক হাজার যোদ্ধার একটি সেনাদল নিয়ে তাদের প্রতিরোধ করার জন্য বের হন এবং উহুদ পাহাড়ের ঢালুতে অবস্থান গ্রহণ করেন। এ যুদ্ধে প্রথম দিকে মুসলমানদের বিজয় হলেও পরে সামান্য ভুল বোঝাবুঝির কারণে কাফেররা পেছন দিক থেকে তীর নিক্ষেপ করে। ফলে মুসলমানদের কাতার ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এতে অনেক মুসলমান শাহাদতবরণ করেন। তাদের মধ্যে শহিদদের সরদার হামজা (রা.)ও ছিলেন। এ যুদ্ধে রাসূল (সা.)-এর মুখমণ্ডল এবং দন্তমোবারক মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়।

খন্দকের যুদ্ধ

মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে পঞ্চম হিজরিতে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে ১০ হাজারেরও বেশি কাফের যোদ্ধা মদিনাভিমুখে রওনা হয়। রাসূল (সা.) কুরাইশদের আগমনের সংবাদ ও উদ্দেশ্য অবগত হওয়ার পর করণীয় নির্ধারণের জন্য সাহাবাদের নিয়ে বসেন। মুসলমানরা প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মদিনার উত্তর পাশের সীমান্ত অরক্ষিত থাকায় সালমান ফারসি (রা.)-এর পরামর্শে পরিখা খননের কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। সাহাবিদের সঙ্গে রাসূল (সা.) নিজেও খনন কাজে অংশগ্রহণ করেন। মোট পনেরো দিনে পরিখা খনন সম্পন্ন হয়।

রাসূল (সা.) মহিলা ও শিশুদের দুর্গে আশ্রয় গ্রহণের নির্দেশ দেন। এক হাজারেরও বেশি মুসলিম যোদ্ধা মুশরিকদের সঙ্গে যুদ্ধ করেন এবং মদিনা প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত হন। মুশরিক সৈন্যরা পরিখার অদূরে মদিনার বাইরে অবস্থান করতে বাধ্য হন। কেননা তাদের বাহনগুলো পরিখা অতিক্রম করতে পারেনি। অতঃপর তাদের অশ্বারোহীরা নিহত হলে অন্যরা পরাজিত হয়ে পলায়ন করে। এক মাস পর্যন্ত মদিনা অবরুদ্ধ ছিল। প্রচণ্ড শীতের গভীর অন্ধকার রাতে প্রবল বাতাস ও তুফান প্রবাহিত হলে মুশরিকদের তাঁবু ছিন্ন-বিচ্ছিন্নসহ যাবতীয় সরঞ্জাম নষ্ট হয়ে যায়।

আবু সুফিয়ান তার উটে আরোহণ করে পলায়ন করে। অন্যান্য সৈন্যরাও তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে। এভাবে মুশরিকদের ব্যর্থতা ও রণক্ষেত্র থেকে পলায়নের মাধ্যমে খন্দক বা আহজাবের যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।

হুদাইবিয়ার সন্ধি

চৌদ্দশত আনুসারী ও মুহাজির সাহাবিদের সঙ্গে নিয়ে ষষ্ঠ হিজরিতে রাসূল (সা.) উমরা করার জন্য মক্কার উদ্দেশে রওনা করেন। ইহরাম বাঁধা অবস্থায় তারা হুদাইবিয়া নামক স্থানে যাওয়ার পর কুরাইশরাদের কাছে তাদের আগমন সংবাদ পৌঁছে। কুরাইশরা শপথ করে যে, নবি করিম (সা.) ও তার সাথিদের মক্কায় প্রবেশ করতে দেবে না। নবিজি (সা.) উসমান (রা.) কে কুরাইশদের কাছে এ খবর দিয়ে প্রেরণ করেন যে, তারা যুদ্ধের জন্য এখানে আসেননি। বরং তারা শুধু উমরার উদ্দেশ্যেই মক্কায় প্রবেশ করতে চান।

তারপর তারা আলোচনায় বসার জন্য সম্মত হয়। আলোচনা আরম্ভ হলে তা সন্ধির মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। এ সন্ধিকেই হুদাইবিয়ার সন্ধি বলা হয়। সিদ্ধান্ত হয় রাসূল (সা.) তার উমরা পালনকে এক বছর পিছিয়ে দেবেন এবং দশ বছর যুদ্ধ বন্ধ থাকবে। আর যে কোনো গোত্র তাদের ইচ্ছানুসারে যে কোনো দলে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে।

এ চুক্তির ফলে খোযাআ গোত্র মুসলমানদের সঙ্গে মিলিত হয় এবং বনু বকর গোত্র কুরাইশদের সঙ্গে মিলিত হয়। সন্ধি চুক্তিসম্পন্ন হওয়ার পর রাসূল (সা.) পশু জবাই করেন এবং মাথা মুড়িয়ে ফেলেন। মুসলমানরা তার অনুকরণ করেন। এর পর তিনি সঙ্গীদের নিয়ে মদিনায় ফিরে যান।

মক্কা বিজয়

হুদায়বিয়ার সন্ধির পর ইসলাম সবচেয়ে দ্রুত বিস্তৃতি লাভ করে। নবিয়ে কারিম (সা.) বিভিন্ন গোত্রে তার দাওয়াতি কর্মসূচি পরিচালনা করতে থাকেন। ফলে এক বছরের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা অধিক হারে বৃদ্ধি পায়। এরই মাঝে কুরাইশদের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ বনু বকর মুসলমানদের মিত্র কবীলায়ে খুযাআর ওপর আক্রমণের মাধ্যমে হুদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তি ভঙ্গ করে।

নবি (সা.) এ সংবাদ পেয়ে খুবই কষ্ট পান এবং মক্কা বিজয়ের উদ্দেশ্যে ১০ হাজার যোদ্ধার একটি বিশাল সেনাদল নিয়ে মক্কাভিমুখে রওনা করেন। এ বিশাল সৈন্যবাহিনী মক্কার কাছাকাছি এলে মক্কাবাসী তাদের দেখে আত্মসমর্পণ করে। নবিজি (সা.) সাহাবিদের সঙ্গে নিয়ে বিজয়ী বেশে মক্কায় প্রবেশ করেন।

কাবার দরজার উভয় পাশের কপাটে হাত রেখে নবিজি (সা.) এক নাতিদীর্ঘ হৃদয়গ্রাহী ভাষণ দেন। তিনি বলেন, ‘তোমাদের প্রতি আজ কোনো অভিযোগ নেই। যাও! তোমরা সবাই মুক্ত।’ শুধু তা-ই নয়, কাফির নেতা আবু সুফিয়ানের গৃহে যে ব্যক্তি আশ্রয় নেবে, তাকেও তিনি ক্ষমা করেন। তিনি ঘোষণা করেন, ‘যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের বাড়িতে আশ্রয় নেবে, সে নিরাপদ থাকবে।’

পরম প্রভুর সান্নিধ্যে

বিদায় হজের পরের বছর ৬৩ বছর বয়সে প্রিয় নবি (সা.) চির দিনের জন্য পরম প্রভুর সান্নিধ্যে চলে যান। তার চলে যাওয়ার দিনটি ছিল ১১ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল, সোমবার। তার প্রতি ও তার পরিবার পরিজনের প্রতি বর্ষিত হোক অজুত কোটি সালাত আর সালাম।

এ জাতীয় আরো সংবাদ

হজ শেষে দেশে ফিরে যে আমল করবেন

নূর নিউজ

‘বাইতুল মুমিন মাদরাসা’ উত্তরার ইফতেতাহি দারস শুরু

নূর নিউজ

জুমার দিনে যে সময় দোয়া কবুল হয়

নূর নিউজ