পলাশ রহমান, ইতালি প্রবাসী সাংবাদিক
প্রবাসীদের কাছে শনি রবিবারের রোজা মানে আলাদা একটা আমেজ। অধিকাংশ মানুষের সাপ্তাহিক ছুটি থাকে। রোজাদাররা কম্যুনিটি মসজিদে যান সবাই এক সাথে ইফতার করতে। প্রতিটি মসজিদে উপচে পড়া ভিড় হয়। শতশত মানুষ ইফতারি করেন। নানা পদের ফল, দেশি ভাজাপোড়া, বিরিয়ানি, তেহারি, রুটি-মাংস, জিলাপিসহ বাহারি ইফতারির আয়োজন করা হয়।
এসব ইফতারির আয়োজন করতে বড় বাজেটের দরকার হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত শুনিনি কোনো মসজিদে ইফতারির আয়োজন করতে অর্থের সংকট হয়েছে। কম্যুনিটির ব্যবসায়ীরাসহ বিভিন্ন সংগঠন এবং ব্যক্তিবর্গ এগিয়ে আসেন। গোটা মাস জুড়ে তারা ইফতারির যোগান দেন। প্রতিদিনই রোজাদাররা মসজিদে ইফতারি করতে যান। কোরান হাদিসের বয়ান শোনেন।
দুঃখের বিষয় হলো এই ইফতারির আয়োজনগুলোয় শুধুমাত্র বাংলাদেশি মুসলমানরা অংশগ্রহণ করেন। কালেভদ্রে দুই একজন ভিনদেশি মুসলমান দেখা যায়।
আজ পর্যন্ত কোনো মসজিদে স্থানীয় অমুসলিমদের দাওয়াত দিতে দেখিনি। জানি না, কেন তাদের দাওয়াত দেয়া হয় না।
আমি মনে করি, স্থানীয় মানুষদের সাথে আমাদের কম্যুনিটির ইন্টিগ্রেশনের জন্য এটা একটা বড় সুযোগ। যা আমাদের মসজিদ কমিটিগুলো বা যারা ইফতারির যোগান দেন, তারা কখনো ভেবেছেন কীনা জানি না।
মসজিদগুলোয় তো প্রতিদিনই ইফতারির আয়োজন করা হয়। অনেক মানুষ ইফতারি করেন। মসজিদের প্রতিবেশি অমুসলিম এবং পরিচিত অমুসলিম বন্ধুদের যদি এসব ইফতারে দাওয়াত দেয়া হয়, এর জন্য আলাদা কোনো খরচের দরকার হবে না। এতে বরং দুইটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে।
১) স্থানীয় মানুষদের সাথে আমাদের ইন্টিগ্রেশন হবে। তারা আমাদের ধর্ম সম্পর্কে জানবেন। আমাদের ধর্মীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে জানবেন। তাদের কারো মধ্যে যদি আমাদের নিয়ে কোনো ভুল ধারণা থাকে তা দুর করতে সহজ হবে। যেমন, ভেনিসের একটি মসজিদে নামাজ আদায় করা স্থানীয় প্রশাসন বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ প্রতিবেশিরা নানা রকম কমপ্লেন করেছেন।
ওই অমুসলিম প্রতিবেশিরা কী আদৌ জানেন, মসজিদের মধ্যে আমরা কী করি? বন্ধ দরজার ভেতরে কী হয়, এমন প্রশ্ন কী তাদের মনে তৈরী হওয়া স্বাভাবিক বিষয় নয়?
আমরা সবাই জানি, ইউরোপের মিডিয়াগুলো ইসলাম, মুসলমান সম্পর্কে খুব ভালো কিছু প্রচার করে না। বরং সুযোগ পেলেই নেতিকথা শোনায়। এসব দেখে, শুনে স্থানীয়দের মধ্যে যে ভুল ধারণা তৈরী হয়, বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়, আমরা কী তা ঘোচাতে কখনো উদ্যোগি হয়েছি?
তাদের কখনো মসজিদে আমন্ত্রণ জানিয়েছি? দেখিয়েছি, মসজিদের ভেতরে কী হয়? আমরা কী করি? কীভাবে করি? আমাদের ধর্মের আদর্শ কী? অথচ গীর্জায় কি হয়, কীভাবে হয় তা আমরা প্রায় সবাই জানি।
ইফতারের সময়ে তাদের দাওয়াত করে এসব বিভ্রান্তি দুর করা সবচেয়ে সহজ। কারণ রমজান সম্পর্কে তাদের অনেকের প্রাথমিক ধারণা আছে। তারা সহজে আমাদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করবেন।
২
ইতালিতে এখন অনেক নওমুসলিম আছেন, যারা ইসলাম সম্পর্কে সঠিক পড়াশুনা করেন এবং চমতকার ভাবে উপস্থাপন করতে পারেন। আমাদের কম্যুনিটিতেও এমন মানুষ আছেন যারা শুদ্ধ ভাবে ইসলামের আদর্শ জানেন এবং ইতালিয় ভাষায় উপস্থাপন করতে পারেন। তাদের মাধ্যমে অমুসলিম প্রতিবেশিদের কাছে ইসলামের দাওয়াত তুলে ধরা যেতো। ইসলাম বিষয়ক তাদের প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেয়া যেতো। আগ্রহীদের পড়াশুনার জন্য দারকারী বই-পুস্তক দেয়া যেতো। নির্ভরযোগ্য ওয়েব ঠিকানা দেয়া যেতো।
আমি মনে করি, এসব করলে প্রতিবেশিদের অভিযোগে ভেনিসের মসজিদে নামাজ আদায় করা বন্ধ হতো না। বরং তারা আমাদের ধর্ম পালনের নিরাপদ ব্যবস্থা করে দিতেন। একজন নেতিকথা বললে তাদের ভেতর থেকে দুজন দাঁড়িয়ে যেতেন আমাদের পাশে।
অমুসলিম প্রধান দেশের কম্যুনিটি মসজিদগুলো টিকিয়ে রাখতে হলে এগুলোকে সত্যিকারার্থে ‘মুসলিম কালচারাল সেন্টারে’ রুপ দেয়া দরকার। মসজিদগুলোকে মিশনারি কাজের কেন্দ্র বানানো দরকার। প্রতি জুমাবারে/রমজানে/ধর্মীয় উৎসবে মসজিদের ভেতরে অমুসলিমদের জন্য বসার জায়গা করা দরকার। নামাজের পরে তাদের সাথে মসজিদের ভেতরেই চা পানের আয়োজন থাকা দরকার। ইসলাম সম্পর্কে তাদের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার ব্যবস্থা থাকা দরকার।
মসজিদ কমিটিগুলো থেকে স্থানীয় সমাজকল্যান কাজে যোগ দেয়া উচিৎ। স্থানীয় আইন শৃংক্ষলা রক্ষায় ভূমিকা রাখা উচিৎ। পরিচ্ছনাতা রক্ষা এবং সমাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখা উচিৎ।
মসজিদ ভিত্তিক মক্তব, তালিমের পাশাপাশি রক্তদান কার্যক্রম, অসহায় অভিবাসীদের (মুসলিম/অমুসলিম) সহযোগীতা কার্যক্রম থাকা উচিৎ।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে মাঝে মাঝে হাসপাতালে রোগীদের দেখতে যাওয়া উচিৎ। জেলখানায় কয়েদিদের দেখতে যাওয়া উচিৎ। যেমনটা করেন গীর্জাগুলোর কর্তৃপক্ষ।
বিশেষ করে শিশু কিশোরদের জন্য মসজিদের ভেতরে সুস্থ বিনোদন এবং হালকা খাবারের বন্দবস্ত করা উচিৎ। প্রত্যেক মসজিদে তথ্য বোর্ড থাকা দরকার। যেখানে অভিবাসীদের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য লটকানো থাকবে। সেখানে সাপ্তাহিক পাঠাসর হবে। বিখ্যাত মনিষিদের জীবনীসহ নবীর সিরাত শোনানো হবে।
এতকিছু হয়তো একসাথে শুরু করা সম্ভব হবে না, কিন্তু ধাপে ধাপে করা উচিৎ এবং তা এ রমজান থেকেই।