লিখেছেন- শরিফ রুবেল
শুরুটা সেই কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে। তখন থেকেই হামলা, মামলা, নির্যাতন যেন পিছু ছাড়ছে না ডাকসু’র সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের। ২০১৮ সালে ডাকসু’র নির্বাচনে জয়ের পর থেকেই ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি হতে থাকে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় একের পর এক হামলার শিকার হন নুরুল হক নুর। প্রতিটি হামলার ক্ষেত্রেই অভিযোগ আসে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। তবে ছাত্রলীগ বার বারই তা অস্বীকার করে। গত ৫ বছরে অন্তত ২৫ বার হামলার শিকার হয়েছেন নুর। এতে বেশ কয়েকবার গুরুতর আহত হয়েছেন। হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। তবে হামলা হলেও কখনো মামলা হয়নি।
মামলা করতে থানায় গেলেও মামলা আমলে নেয়া হয়নি। উল্টো নুরের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। মারধরের পর অনেকবার থানায় অভিযোগ নিলেও তা এজাহার হিসেবে গ্রহণ করেনি পুলিশ। কাউকে কখনো গ্রেপ্তারও করা হয়নি। অনেকে বলছেন, নুরের ওপর এই হামলা যেন দায়মুক্তির। দেশের একজন নাগরিক এভাবে বার বার হামলার শিকার হচ্ছেন কিন্তু কোনো বিচার হচ্ছে না।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ২০১৮ সালের ৩০শে জুন নুরের ওপর প্রথম হামলা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে আন্দোলনকারীদের ওপর ওই হামলা করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তখন নুরসহ বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হোন। এরপর হামলার শিকার হন ডাকসু নির্বাচনের দিন ২০১৮ সালের ১১ই মার্চ। নির্বাচনে ভোট কারচুপির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ঢাবি’র রোকেয়া হলে ছাত্রলীগের মারধরের শিকার হোন নুর। হামলায় আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় তাকে। সেখানে বসেই ভিপি পদে জয়ের সংবাদ পান তিনি। ওখানেই শেষ নয়, ভিপি হয়ে ক্যাম্পাসে এসেই হামলার মুখে পড়েন নুর। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরদিন ১২ই মার্চ ঢাবিতে ঢোকার পর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তার ওপর হামলা করে। চড়- ধাপ্পড় মেরে আহত করা হয়। এ ছাড়াও ২০১৮ সালের ২রা এপ্রিল এক ছাত্রকে পিটিয়ে আহত করার প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে এসএম হলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বাধার মুখে পড়েন ভিপি নুর। সেখানেও তাকে কিলঘুষি মারা হয়।
এরপরের হামলা ও বাধার মুখে পড়েন ইফতার মাহফিল করাকে কেন্দ্র করে। ২০১৯ সালের ২৫শে মে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ইফতারে গিয়ে জেলা ছাত্রলীগের বাধার মুখে পড়েন নুর। তখন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাকে ঠেলা দিয়ে মঞ্চ থেকে ফেলে দেন। বাধায় ইফতার না করেই ফিরে যেতে হয় তাকে। ২০১৯ সালের ১২ই মার্চ নুরুল হক নুর ও তার সহকর্মীদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ওই হামলার ঘটনা ঘটে। তখন নুর গুরুতর আহত হয়ে ৪ দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। তবে ওই ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। শাহবাগ থানায় ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলেও তা নেয়া হয়নি। উল্টো নুরের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করা হয়। ২০২১ সালের ১৭ই নভেম্বরে টাঙ্গাইলের সন্তোষে মওলানা ভাসানীর মাজারে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে ছাত্রলীগের দু’দফায় হামলার শিকার হোন নুরুল হক নুর। তবে পুলিশ হামলার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। ওই ঘটনায় কোনো মামলাও নেয়া হয়নি।
২০১৯ সালের ১৭ই ডিসেম্বর নুরুল হক নুরের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতাকর্মীরা। এতে নুরের বাম হাতের আঙ্গুল ভেঙে দেয়া হয়। গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন নুর। তখন নুরুল হক নুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি ছিলেন। ওই ঘটনায় ২৪শে ডিসেম্বর পুলিশ বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় মামলা দায়ের করে। হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আল মামুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক ইয়াসিন আরাফাত তূর্য ও দপ্তর সম্পাদক মেহেদী হাসান শান্তকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে এক সপ্তাহ পরেই তারা জামিনে বেরিয়ে যান। ২০১৯ সালের ২৬শে মে বগুড়ায় ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছিলেন নুরুল হক নুর। হামলায় আহত নুরকে তখন এম্বুলেন্সে করে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। তবে ওই ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি।
চলতি বছরের ১৮ই জুলাই গণঅধিকার পরিষদের কার্যালয় দখল নিয়ে পুলিশের সঙ্গে হট্টগোল হয় দলটির নেতাকর্মীদের। এ সময় পুলিশের ধস্তাধস্তিতে নুরসহ দু’জন আহত হোন। পরে হাসপাতালে ভর্তি হোন নুর। গত ২রা আগস্ট বড় হামলার ঘটনা ঘটে। বুধবার বিকালে বিরোধী রাজনৈতিক দলের ওপর হামলা-মামলা-হয়রানি বন্ধ, গুলিস্তানে মাদ্রাসা শিক্ষার্থী হাফেজ রেজাউল করিম হত্যা এবং বুয়েট শিক্ষার্থীদের আটকের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি’র সামনে সমাবেশ ডাকে। সেই সমাবেশে যোগ দিতে শাহবাগ থেকে মিছিল নিয়ে টিএসসি’র কাছাকাছি এলে হামলার শিকার হন নুর। হামলায় নুরসহ ছাত্র অধিকার ও গণঅধিকার পরিষদের ৩০ থেকে ৩৫ জন আহত হন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ছাত্রলীগ লাঠিসোটা নিয়ে হামলা চালায় নুরের মিছিলে। এসময় নুরকেও বেধড়ক পেটানো হয়। এই পরিস্থিতিতে নুর ও তার সহযোগীরা দোয়েল চত্বর দিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে যান। পরে নুরকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হয়।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের একচ্ছত্র আধিপত্যের প্রতি নুরুল হক নুর কার্যত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলন সফল হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে ‘গেস্ট-রুম’-‘গণ-রুম’ এবং ছাত্রলীগ নেতাদের সালাম দিয়ে চলার যে সংস্কৃতি ছিল সেটি অনেকটা কমে এসেছে। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা যখন রাজনীতির মাঠে গরহাজির তখন নুরুল হক নুর ক্রমাগত হামলার শিকার হয়েও জায়গা ছেড়ে দেননি। উল্টো তিনি ছাত্রলীগের সমালোচনায় মুখর। এ বিষয়টি তার জন্য একটি ভিন্নমাত্রা এনে দিয়েছে।
এ বিষয়ে গণঅধিকার পরিষদের উচ্চতর পরিষদের সদস্য আবু হানিফ মানবজমিনকে বলেন, নুরের ওপর যতবার হামলা হয়েছে। সব সময়ই সরকার বা তাদের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা করেছে। তারা নুরকে প্রতিপক্ষ মনে করে। এ পর্যন্ত নুুরের ওপর প্রায় ২৫ বার হামলা করা হয়েছে। প্রতিবারই তারা হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করেছে। তবে তারা ব্যর্থ হয়েছে। সফল হতে পারেনি। হামলা হলে আমরা মামলা করতে গেলে মামলা নেয়া হয় না। বরং মার খাই আমরা। উল্টো আমাদের বিরুদ্ধেই মামলা দেয়া হয়। এই সরকারের পুলিশ ও আদালতের প্রতি আমাদের আস্থা নেই। তাই এখন হামলা হলেও আর মামলা করতে যাই না। কারণ গেলেও লাভ নেই। তারা মামলা নিবে না সেটা আমাদের জানা আছে। তাই এখন থেকে হামলা হলে রাজনৈতিকভাবে জবাব দিতে হবে। থানায় গিয়ে সময় নষ্ট করে লাভ নাই।