সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে প্রায় অর্ধশত দলকে সঙ্গে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনে রয়েছে বিএনপি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিলের আগেই রাজপথে এর সমাধান করতে চায় দলটি। দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, এক্ষেত্রে আপসের কোনো সুযোগ নেই। ইসির পক্ষ থেকে নভেম্বরের কথা বলা হলেও বিএনপির কাছে তথ্য আছে, তাদের অপ্রস্তুত রেখে অক্টোবরের যে কোনো সময় নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করা হতে পারে। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই চূড়ান্ত আন্দোলনের পরিকল্পনা সাজাচ্ছে দলটির হাইকমান্ড। তারা তপশিল ঘোষণা পর্যন্ত চলমান আন্দোলনকে টেনে নিয়ে যেতে চায় না।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে একদফার যুগপৎ আন্দোলন গতি লাভ করবে। সেক্ষেত্রে সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে গিয়ে আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেবে। ওই সময় ঢাকায় ফের মহাসমাবেশ, গণসমাবেশ বা বড় ধরনের কর্মসূচির চিন্তা রয়েছে হাইকমান্ডের। এর মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত আন্দোলনের ‘শেষ ধাপ’ শুরু হবে, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত যা চলমান থাকবে। তখন কর্মসূচি হবে ঢাকাকেন্দ্রিক। বিচারালয়ের সামনে অবস্থান ছাড়াও নির্বাচন কমিশন, গণভবন, সচিবালয়ের মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঘেরাওয়ের সঙ্গে টানা অবস্থানের কর্মসূচি আসবে।
এর আগে দলের ৪৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করবে বিএনপি। আলোচনা সভা ছাড়াও বিশাল আয়োজনে বর্ণাঢ্য র্যালি করবে দলটি। নেতাকর্মীদের ব্যাপক অংশগ্রহণে র্যালি একদফার কর্মসূচির মতো রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে হাইকমান্ড।
এদিকে যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে নতুন করে ঢাকাসহ দেশব্যাপী দুদিনের গণমিছিলের কর্মসূচি আসছে। আগামী শুক্রবার ঢাকায় এবং পরদিন শনিবার ঢাকার বাইরে সব মহানগরে কালো পতাকা সহকারে গণমিছিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। গত সোমবার দলটির স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে নতুন এই কর্মসূচির বিষয়ে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দল ও জোটগুলোকে জানিয়ে দিয়েছে বিএনপি। গতকাল রাতে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে দলের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী একদফার নতুন এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। বিএনপির শরীকরা আজ বুধবার যুগপৎভাবে এই কর্মসূচি ঘোষণা করবে।
এর আগে কর্মসূচি প্রণয়নের লক্ষ্যে শরিক দল ও জোটগুলোর কাছ থেকে প্রস্তাবনা নেয় বিএনপি। তখন গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বৈঠকে নতুন কর্মসূচি হিসেবে গণমিছিল অথবা পদযাত্রার ব্যাপারে নীতিগতভাবে একমত হয় দলটি। সে কারণে গণতন্ত্র মঞ্চ যুগপৎ আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি হিসেবে গণমিছিল ও মিছিল-পূর্ব সমাবেশ করবে বলে মঞ্চ সূত্রে জানা গেছে। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের চলমান আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হবে। বিএনপি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ দাবি আদায় করবে।
সরকারবিরোধী আন্দোলন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গত ২৮ জুলাই ঢাকায় মহাসমাবেশ ডাকে বিএনপি। সে সময় দলটির পরিকল্পনা ছিল, ঢাকাকেন্দ্রিক লাগাতার কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দ্রুততম সময়ে আন্দোলনকে লক্ষ্যে পৌঁছানো। কারণ, মহাসমাবেশ ঘিরে সারা দেশ থেকে লাখ লাখ নেতাকর্মী তখন ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। পরদিন ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচি দলের চাহিদা অনুযায়ী বাস্তবায়িত না হওয়ায় নতুন চিন্তাভাবনা শুরু করে হাইকমান্ড। নেতাকর্মীরা লাগাতার কর্মসূচির পরিকল্পনা থেকে সরে এসে বিরতি দিয়ে যুগপৎ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সে অনুযায়ী, চলতি আগস্ট মাসে এখন পর্যন্ত নরম কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি।
এদিকে অবস্থান কর্মসূচি ঘিরে সমন্বয়হীনতা ও সাংগঠনিক দুর্বলতার বিষয়টি সামনে চলে আসায় আন্দোলনে গতি আনতে এরই মধ্যে কিছু সাংগঠনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বিএনপির হাইকমান্ড। ছাত্রদল সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণকে দায়িত্ব থেকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ভেঙে দেওয়া হয়েছে ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ যুবদলের কমিটি। ঢাকা মহানগর বিএনপিসহ অন্য অঙ্গসংগঠনের নেতৃত্বে থাকা আন্দোলনবিমুখ নেতাদের বিরুদ্ধেও কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে গুঞ্জন ছিল। তবে গত ১১ আগস্ট ঢাকার গণমিছিলে ব্যাপক জনসমাগমের পর দলের হাইকমান্ড কঠোর অবস্থান থেকে আপাতত সরে এসেছে। অবশ্য এখনই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া না হলেও চিহ্নিত নেতাদের পর্যবেক্ষণে রাখা হবে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলনে যাতে ছন্দপতন না হয় এবং লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়, সেজন্য কাজ করছে দল। বিশেষ করে কর্মসূচি বস্তবায়নের জন্য হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে দলের বিভিন্ন স্তরে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই দলীয় বিভিন্ন ফোরামের নেতাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করছেন হাইকমান্ড। সেখানে ওই নির্দেশনার পাশাপাশি এই মেসেজও দেওয়া হচ্ছে, সরকারের সঙ্গে কোনো সমঝোতা বা আপস নয়, রাজপথের আন্দোলনেই দাবি আদায় করতে হবে। মাঠে থেকে প্রতিটি কর্মসূচি শতভাগ সফল করতে হবে।
বিএনপির অভিযোগ, একদফার আন্দোলন দমাতে সরকার হামলা-মামলা, দমন-পীড়নের পথ বেছে নিয়েছে। সম্প্রতি ঢাকায় নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের পরিমাণ বেড়েছে। দলের বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক সালাউদ্দিন আহমেদ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম-সম্পাদক মমিনুল ইসলাম জিসানসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে কিছু নেতা গ্রেপ্তার আতঙ্কে রয়েছেন। চূড়ান্ত আন্দোলন সামনে রেখে এটা কীভাবে কাটিয়ে ওঠা যায়, সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে দল।
অন্যদিকে গত শনিবার রাতে তানভীর আহমেদ রবিন গ্রেপ্তার হওয়ার প্রেক্ষাপটে চলমান আন্দোলনে রাজধানীতে সংগঠনের গতিশীলতা অব্যাহত রাখতে দক্ষিণে কাকে দায়িত্ব দেওয়া যায়, সে ব্যাপারে দলের পক্ষ থেকে ভাবা হচ্ছে। কয়েকদিনের মধ্যে তিনি কারামুক্ত না হলে তার স্থলে নতুন কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হবে। গত বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণের সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনু গ্রেপ্তারের ১৭ মাস পর গত ৫ জুলাই সংগঠনের ৯ নম্বর যুগ্ম-আহ্বায়ক রবিনকে ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব করা হয়।