আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন সৃষ্টির সেরা জীব হিসাবে। মানুষকে কেন্দ্র করেই প্রকৃতি-পরিবেশ ও সমাজ গঠিত হয়েছে। মানুষ ছাড়া প্রকৃতি টিকে থাকতে পারে ঠিকই, কিন্তু প্রকৃতি ছাড়া মানুষের টিকে থাকা অসম্ভব। আল্লাহ মানুষের আবাসের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। মানুষের কল্যাণ ও জীবন ধারণের প্রয়োজনে পরিবেশে বিদ্যমান যাবতীয় উপাদান নিয়ামত হিসাবে দান করেছেন। আল্লাহ বলেছেন, ‘জমিনে যা কিছু আছে সব কিছু তোমাদের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে।’ (সূরা বাকারা-২৯)।
কিন্তু আল্লাহ প্রদত্ত এসব নিয়ামত এখন ধ্বংসের মুখে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের পরিবেশ আজ চরম হুমকির মুখে। ফলে মানবজীবন আজ বিপর্যস্ত। এ বিপর্যয়ের জন্য প্রকৃতি যতটা না দায়ী তার চেয়েও বেশি দায়ী আমাদের মানবসমাজ। মানুষের বিবেকহীন প্রকৃতি বিদ্বেষী কর্মকাণ্ড পরিবেশকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। ক্ষণিকের লাভের জন্য অবাধে বৃক্ষ নিধন করে গড়ে তুলছে আবাসন কিংবা শিল্প কারখানা, নির্বিচারে গাছ কেটে উজাড় করছে বন। এতে করে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য, হারিয়ে যাচ্ছে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত প্রকৃতির সৌন্দর্য।
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যেখানে জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব কিছু সুবিন্যস্তভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ইবাদতের ব্যাপারে ইসলাম যতটা সোচ্চার, ঠিক ততটাই গুরুত্বারোপ করেছে পরিবেশর প্রতিও। মানুষের জন্য কী ধরনের পরিবেশ উপযোগী এবং কোন পরিবেশে মানুষ সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে পারবে ইসলাম তা সুনিশ্চিত করেছে। পৃথিবীতে প্রাণিকুলের টিকে থাকার জন্য ভারসাম্যপূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশ দরকার, সুস্থ ও সুন্দরভাবে জীবনধারণের জন্যও এর বিকল্প নেই। আমাদের চার পাশের গাছপালা, মাটি, পানি, বায়ু, জীবজন্তু, পশুপাখি, রাস্তাঘাট, নদীনালা, পাহাড়-পর্বত, যানবাহন, বাড়িঘর ও কল-কারখানা ইত্যাদি এসব পরিবেশের উপাদানগুলো আল্লাহ আমাদের জন্য নিয়ামত হিসাবে দান করেছেন।
আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘জমিনকে আমি বিস্তৃত করেছি এবং তাতে সুদৃঢ় পাহাড় স্থাপন করেছি। আর তাতে উৎপন্ন করেছি সব ধরনের বস্তু সুনির্দিষ্ট পরিমাণে। আর তাতে তোমাদের জন্য এবং তোমরা যার রিজিকদাতা নও তাদের জন্য রেখেছি জীবনোপকরণ। আর প্রতিটি বস্তুরই ভান্ডারগুলো রয়েছে আমার কাছে এবং আমি তা অবতীর্ণ করি কেবল নির্দিষ্ট পরিমাণে। আর আমি বায়ুকে উর্বরকারীরূপে প্রেরণ করি অতঃপর আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করি এবং তা তোমাদের পান করাই। তবে তোমরা তার সংরক্ষণকারী নও। (সূরা আল-হিজর : ১৯-২২)।
মানুষ ও প্রাণিকুল সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন সুস্থ এবং সুন্দর পরিবেশ। স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ ও উন্নত জীবনযাপন একে অপরের পরিপূরক। ইসলাম সব সময় সৌন্দর্যমণ্ডিত পরিবেশের সমর্থন করে। সৃষ্টিকুলের জীবন ধারণের সব উপকরণ তিনি পরিমিতভাবে ও যথাস্থানে স্থাপন করে রেখেছেন।
আল্লাহ বলেন, ‘আর আমি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করি, ওর সাহায্যে সব রকমের উদ্ভিদ উৎপন্ন করি; অতঃপর তা থেকে সবুজ শাখা বের করি, ফলত তা থেকে আমি উপর্যুপরি উত্থিত বীজ উৎপন্ন করি এবং খেজুর বৃক্ষ থেকে অর্থাৎ ওর পুষ্পকণিকা থেকে ছড়া হয় যা নিম্নদিকে ঝুঁকে পড়ে, আর আঙুরগুলোর উদ্যান এবং যাইতুন ও আনার যা পরস্পর সাদৃশ্যযুক্ত। প্রত্যেক ফলের প্রতি লক্ষ কর যখন ওটা ফলে এবং ওর পরিপক্ব হওয়ার প্রতি লক্ষ কর। নিশ্চয় এগুলোতে ইমানদারদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সূরা আন’আম : ৯৯)।
বর্তমানে পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে বিশ্ববাসী উৎকণ্ঠিত। বিজ্ঞানীরা নিরন্তর গবেষণা করে যাচ্ছেন কীভাবে পরিবেশ সংরক্ষণ করে পৃথিবীকে ধ্বংসের কবল থেকে রক্ষা করা যায়। কিন্তু পরিবেশ সংরক্ষণে যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি দরকার তা হচ্ছে, সৃষ্টির প্রতি আমাদের সচেতনতাবোধ। কিন্তু আদৌ কি এ সচেতনতাবোধ আমাদের মাঝে তৈরি হচ্ছে?
সৃষ্টির সেরা জীব হয়েও আমরা পরিবেশ দূষণে মত্ত হয়ে আছি। নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন করছি, পাহাড় কেটে সমভূমি তৈরি করছি, যেখানে সেখানে কফ-থুতু যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা নিক্ষেপ করছি। আমরা পানি, বায়ু, মাটি দূষণ করছি, আর এসব দূষণের ফলে দূষিত হচ্ছে আমাদের পরিবেশ। অথচ এসব আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত জরুরি। আল্লাহ আমাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসাবেই এসব নিয়ামত দান করেছেন। কিন্তু আমরা নিজেরাই নিজেদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার পথের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছি।
পরিবেশ দূষণের ফলে স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হয়। দূষিত পরিবেশ রোগব্যাধি সংক্রমণের প্রধান আবাসস্থল। তাই পরিবেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে সংরক্ষণ করার মাধ্যমে মারাত্মক ও সংক্রামক রোগ-ব্যাধি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। সুস্থতা, সৌন্দর্য, মননশীলতা, উৎকর্ষ ও সমৃদ্ধির কথা বলে ইসলাম। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রে ইসলামের অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইমানের অঙ্গ।’ (মুসলিম : ২২৩)। অর্থাৎ মুসলিম হিসাবে, ইমানদার ব্যক্তি হিসাবে এবং একজন প্রকৃত মুমিন হিসাবে জাহির হতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিকল্প নেই।
প্রতিটি জীবের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন সুস্থ ও মনোরম পরিবেশ। অনুকূল পরিবেশ ছাড়া কোনো জীবের অস্তিত্ব রক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই আমাদের উচিত ইসলামের আলোকে পরিবেশ সংরক্ষণ করা এবং এ বিষয়ে সোচ্চার হওয়া। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নির্ভরযোগ্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে বৃক্ষ নিধন নয়, পরিবেশের পরিচর্যা করতে হবে। রাসূল (সা.) প্রকৃতি-পরিবেশ সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিশেষভাবে দিকনির্দেশনা আরোপ করেছেন।
পরিবেশকে বসবাস উপযোগী তথা সুস্থ, সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন রাখতে ইসলাম দিয়েছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা। আল্লাহ বলেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন সমুদ্র ও স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে’ (সূরা আর রুম : ৪১)। আল্লাহতায়ালা পৃথিবীতে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় ও জীব জগতের অস্তিত্ব রক্ষায় সৃষ্টি করেছেন গাছপালা ও পর্বতমালা। আল্লাহ বলেন, ‘আমি বিস্তৃত করেছি ভূমিকে ও তাতে স্থাপন করেছি পর্বতমালা এবং উৎপন্ন করেছি নয়নাভিরাম বিবিধ উদ্ভিদরাজি। এটি আল্লাহর অনুরাগী বান্দাদের জন্য জ্ঞান ও উপদেশস্বরূপ’ (সূরা কাফ : ৭-৮)।
গাছ মানুষ ও পরিবেশের বন্ধু। সবুজ গাছপালার ওপরই নির্ভর করে মানুষসহ পরিপূর্ণ প্রাণী জগতের অস্তিত্ব। গাছপালা সংরক্ষণের নির্দেশ হুঁশিয়ারি দিয়ে নবিজি (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি বিনা প্রয়োজনে গাছ কাটবে, আল্লাহ তার মাথা আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করবেন’ (আবু দাউদ : ৫২৪১, বায়হাকী : ৬/১৪০)। পরিবেশের ভারসাম্যের জন্য গাছ লাগানোর শিক্ষা আমরা মহানবি (সা.)-এর হাদিস থেকে পাই। তিনি বলেছেন, যদি তুমি মনে কর আগামীকাল কেয়ামত হবে, তবু আজ একটি গাছ লাগাও।
কুরআনে পাহাড়-পর্বতকে পৃথিবীর পেরেক বলে উল্লেখ করা হয়েছে; কিন্তু মানুষ অবাধে বনজঙ্গল উজাড় করে ও পাহাড় কেটে নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস ডেকে নিয়ে আসছে। অবুঝ মানুষ নিজের প্রতি কত বড় অবিচার করছে, তা আমাদের চারপাশে চোখ বোলালেই বোঝা যায়।
আমাদের অসচেতনতা ও অবহেলায় পৃথিবীর পরিবেশ দিন দিন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। জীবের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেছে বহুগুণে; যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
সুন্দর ও স্বাচ্ছন্দ্যময় সামাজিক পরিবেশ গঠনে খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, রাস্তাঘাট পরিষ্কার থাকা অপরিহার্য। নবিজি (সা.) বলেছেন, ইমানের ৭৩টি শাখা, তন্মধ্যে সর্বোত্তমটি হলো, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আর সর্বনিম্নটি হলো, রাস্তা থেকে ক্ষতিকারক বস্তু দূর করা। তিনি আরও বলেছেন, পবিত্রতা ইমানের অর্ধাংশ।
পরিবেশের সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ইসলামে রয়েছে স্বতন্ত্র ও পূর্ণাঙ্গ নির্দেশনা; যা অনুসরণ করলে বিশ্বব্যাপী একটি সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব। পরিবেশ সংরক্ষণে রাষ্ট্র ও সমাজ ইসলামের আলোকে নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে সামর্থ্য হলে বৈশ্বিক পরিবেশ বিপর্যয়ের হার বহুলাংশে কমে আসবে ইনশাআল্লাহ।