বন্যার্তদের পাশে দাঁড়িয়ে প্রশংসায় ভাসছে আলেম সমাজ

উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও ভারি বর্ষণে প্লাবিত বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল। ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, চট্টগামসহ বেশ কয়েকটি জেলায় প্রবল বন্যায় বিপর্যস্ত।

এমন পরিস্থিতিতে বন্যায় বিপন্ন জনপদে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিচ্ছেন বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। সাধ্যের সবটুকু দিয়ে শুরু থেকেই বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন দেশের আলেমরা। উদ্ধার কাজ থেকে শুরু ত্রাণ তৎপরতা, সবকিছুতেই এগিয়ে ছিলেন তারা।

শুধু তাই নয়, আকস্মিক বন্যা শুরু হওয়ার পর বন্যার্ত অঞ্চলের মাদ্রাসাগুলো হয়ে উঠেছে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব মানুষের আশ্রয়স্থল। এসব মাদ্রাসায় শুধু মানুষকে আশ্রয় দেওয়া হয়নি; বরং নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের খাবারেরও ব্যবস্থা করছে এসব মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ।

ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লায় এবারের বন্যা ছিল অনেক আকস্মিক ও আগ্রাসী। হঠাৎ করে এভাবে বন্যায় আক্রান্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা ওই অঞ্চলের মানুষের ছিল না। তাছাড়া গত বুধবার রাতে অল্প সময়ের মধ্যে উজান থেকে নেমে আসা ঢলে তলিয়ে যায় ফেনীর অধিকাংশ এলাকা। বিপর্যস্ত মানুষকে শুধু আশ্রয় নয়, ঘর থেকে উদ্ধারও করেছেন মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা।

ফেনী জেলার বৃহত্তর দ্বীনি প্রতিষ্ঠান জামেয়া রশীদিয়ার প্রতিষ্ঠাতা মুফতি শহীদুল্লাহ বলেন, আমার এ দীর্ঘ জীবনে এ অঞ্চলে কখনো এমন বন্যা দেখিনি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বন্যায় সব ভেসে গেল। আমাদের নিচতলায় থাকা সব জিনিসপত্র, জেনারেটরসহ মূল্যবান আসবাব সব চলে গেল পানির নিচে। এমন পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক এলাকার সবাইকে মাদ্রাসায় আশ্রয় নেওয়ার জন্য আমি খবর পাঠাই। নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কারণে যাদের বলা সম্ভব হয়নি তাদের বাড়িতে আমাদের ছাত্ররা গিয়ে উদ্ধার করে এনেছে।

ভয়াল সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, যখন জানতে পারলাম ঘরবাড়িতে মানুষ আটকে পড়েছেন আমাদের ছাত্ররা বড় বড় পাতিল নিয়ে তাৎক্ষণিক তাদের উদ্ধার করেছে। এক নারী জানালেন তার শাশুড়ি ঘরে আটকা পড়েছে, আমাদের ছাত্ররা ওই বাড়িতে গিয়ে টিন কেটে তাদের উদ্ধার করেছে। একটি পরিবারের সদস্যরা শিশুদের বাড়িতে রেখে শহরে গিয়েছিল, আমাদের ছাত্ররা গিয়ে দেখে ওই ঘরে শিশুরা গ্রিল ধরে পানি থেকে বাচার চেষ্টা করছে। পরে জানালা কেটে তাদের উদ্ধার করে আনা হয়। এভাবে প্রতিকুল পরিস্থিতির মধ্যে আমরা উদ্ধার এবং আশ্রয়ণের কাজ একসঙ্গে চালিয়েছি। যেখানে হেঁটে যেতে ১০-১৫ লাগে, সেখান থেকে উদ্ধার করে আনতে তীব্র স্রোতের কারণে কয়েক ঘন্টা লেগেছে।

মুফতি শহীদুল্লাহ বলেন, মাদ্রাসায় আনুমানিক পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। একটি বিল্ডিংয়ে শুধু গবাদি পশু রাখার ব্যবস্থা করেছি। ৫০টির বেশি হিন্দু পরিবারও মাদ্রাসায় অবস্থান করেছে এ কয়েকদিন। প্রতিদিন গড়ে আমরা ৬ হাজার মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করেছি। আমাদের গোডাউনে থাকা অধিকাংশ চাল-ডাল পানির নিচে ছিল। তাছাড়া গ্যাসের সংকটও ছিল। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আমরা আল্লাহর উপর ভরসা রেখে যথাসাধ্য মানুষের খেদমত করে যাচ্ছি। এখন পানি নামারও পরও কয়েক হাজার মানুষ আমাদের আশ্রয়ে রয়েছেন। এখন সবার বাড়ি বাড়ি ত্রাণ পাঠানো হচ্ছে।

জামেয়া রশীদিয়া ছাড়াও ফেনী-নোয়াখালীর অধিকাংশ মাদ্রাসায় এভাবে বন্যার্তদের আশ্রয় ও খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায় অবস্থিত দারুল উলুম আল হোসাইনিয়া ওলামা বাজার মাদ্রাসায় বহুসংখ্যক বন্যার্ত মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। স্থানীয়দের সহায়তায় মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ প্রতি বেলায় এক হাজার মানুষের খাবার পরিবেশন করছে।

ফেনী সদর উপজেলার আল জামিয়া আল ইসলামিয়া দারুল উলুম শর্শদি মাদরাসায় আশ্রয় নিয়েছে অসংখ্য মানুষ। এখানে প্রতিদিন দুই বেলা দুই হাজার মানুষের খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে।

পরশুরাম উপজেলার পশ্চিম অলকা ফারুকিয়া মাদ্রাসাও বন্যার্তদের আশ্রয়কেন্দ্র ছিল। এখানে প্রতিদিন এক হাজার মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দাগনভূঞায় অবস্থিত আশরাফুল উলুম মাদরাসায় প্রতি বেলায় তিনশ মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

কুমিল্লা সদরের মাদরাসা জামিয়া মাদানিয়া রওজাতুল উলুম। এখানে আশ্রয় নিয়েছে পাঁচ শতাধিক মানুষ। মাদরাসা কর্তৃপক্ষ তাদের খাবারের ব্যবস্থা করছে।

এছাড়া নোয়াখালী জেলার কালিকাপুর এমদাদুল উলুম কওমি মাদরাসা, জামিয়া আহলিয়া আমানতপুর মাদরাসা, নাজিরপুর ইসলামিয়া আরাবিয়া মাদরাসা, চৌমুহনি ইসলামিয়া আরাবিয়া মাদরাসা, লাকড়িয়াকান্দি খাদিজাতুল কুবরা মহিলা মাদরাসা, গোপালপুর বাজার ফাতেমা (রা.) মহিলা মাদরাসা, জামিয়া মিফতাহুল উলুম ধন্যপুর, জামিয়া মাদানিয়া, দত্তেরহাট ইত্যাদি মাদরাসায় সাধারণ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।

মাদ্রাসার পাশাপাশি বিভিন্ন ইসলামিক দল, আলেমদের পরিচালিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা বন্যাদুর্গত অঞ্চলে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এছাড়া ইমাম-খতিবদের নেতৃত্বে বিভিন্ন এলাকা থেকে ত্রাণ নিয়ে দূর্গতদের পাশে দাঁড়িয়েছেন সাধারণ মুসল্লিরা।

শুরু থেকেই বন্যাকবলিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে শায়খ আহমাদুল্লাহর আসসুন্নাহ ফাউন্ডেশন। বন্যার্তদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য বিরামহীন কর্মযজ্ঞ পরিচালতি হচ্ছে তাদের। বন্যার্তদের জন্য তিন ধাপে ত্রাণ বিতরণ ও বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসনের জন্য এ বছর সর্বমোট ১০০ কোটি টাকার সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ফাউন্ডেশনটির চেয়ারম্যান শায়খ আহমাদুল্লাহ।

যেকোনো জাতীয় দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়ায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। এবারের আকস্মিক বন্যায় পিছিয়ে নেই দলটি। দলের আমির ও চরমোনাইয়ের পির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের নির্দেশে দলটির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা বন্যাদুর্গত এলাকায় ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছে।

বন্যার প্রথম দিন থেকে আক্রান্ত মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে আলেমদের সংগঠন জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদ। বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত তিন জেলা নোয়াখালী, ফেনী ও কুমিল্লায় চলছে তাদের ত্রাণকার্যক্রম। কুমিল্লার পদুয়ার বাজারে স্থাপিত অস্থায়ী ক্যাম্প থেকে তা পরিচালনা করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত সংগঠনটি আনুমানিক ১০ টন চাল, সাত টন আলু, দুই টন পেঁয়াজ, দুই টন ডাল, তিন হাজার প্যাকেট লবণ, তিন হাজার কেজি তেল, সাত হাজার লিটার বিশুদ্ধ খাবার পানি বিতরণ করেছে।

এছাড়া আল মারকাজুল ইসলামী, তাকওয়া ফাউন্ডেশন, খেলাফত যুব মজলিস, ফি সাবিলিল্লাহ ফাউন্ডেশন, শানে সাহাবা খতিব ফাউন্ডেশন, সেবাসংস্থা পিসব, হাফেজ্জী হুজুর সেবা সংস্থা, রহমাতুল্লিল আলামিন, ইসলাহুল মুসলিমীন পরিষদ কাজ করে যাচ্ছে।

দেশের সংকটময় পরিস্থিতিতে বন্যা দুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়েছে পল্টন-সেগুনবাগিচা ইমাম খতিব পরিষদ। সংগঠনটির পক্ষ থেকে কয়েক দফায় খাদ্যসামগ্রী, বিভিন্ন ওষুধপত্র ও নগদ অর্থ বিতরণ করা হয়েছে।

লিখেছেন, দৈনিক যুগান্তরের সহ-সম্পাদক মুফতি তাঞ্জিল আমির।

এ জাতীয় আরো সংবাদ

যুক্তরাষ্ট্রের কাছে টিকা চেয়েছে বাংলাদেশ

আনসারুল হক

ড. ইউনূসের সঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার মার্কিন প্রতিনিধি দলের

নূর নিউজ

মানবাধিকার রক্ষায় অটুট থাকবে পশ্চিমা মিশনগুলো

নূর নিউজ