ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক ৩ মসজিদ

ইতিহাস, ঐতিহ্যের ভূমি ফিলিস্তিন। এই ভূমিতে আল্লাহ তায়ালা বনী ইসরাঈলের একাধিক নবী প্রেরণ করেছিলেন। মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম আ. নিজগোত্র থেকে হিজরত করেছিলেন এই ভূমিতে। ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি লাভ করে মুসা কালিমুল্লাহ আ.ও ফিলিস্তিনে এসেছিলেন বনী ইসরাঈলকে নিয়ে। ঈসা আ.-এর জন্ম ও নবুয়তের ভূমি ছিল ফিলিস্তিন। এই ভূমির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ সা.-এর ইসরা ও মেরাজের স্মৃতি।

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শাসকেরা এই ভূমি শাসন করেছেন। হিজরী ১৪ সালে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ফিলিস্তিন বিজয় করেন। এরপর ক্রুসেড আক্রোমণ, মুসলিম শাসকদের উদ্ধার— বিভিন্ন ইতিহাসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে ফিলিস্তিনকে। এখনো এই ভূমির স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে চলেছেন এর অধিবাসীরা।

আল আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাস

মসজিদুল আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান। এই মসজিদটি ইসলামের প্রথম কেবলা হিসেবে পরিচিত। মক্কার কাবাকে নামাজের কিবলা হিসেবে নির্ধারণের আগ পর্যন্ত মসজিদুল আকসার দিকে ফিরে নামাজ আদায় করতেন প্রিয়নবী সা. ও সাহাবিগণ। কিবলা পরিবর্তনের আয়াত নাজিল হলে কাবার দিকে ফিরে নাামাজ আদায় করা শুরু হয়।

আল আকসা ফিলিস্তিনের জেরুজালেম শহরে অবস্থিত। আল আকসা পৃথিবীতে নির্মিত দ্বিতীয় মসজিদ। মক্কায় মসজিদুল হারাম নির্মাণের ৪০ বছর পরে এই মসজিদ নির্মাণ করা হয়। প্রথম কে আল আকসা নির্মাণ করেন তা নিশ্চিত করে জানা না গেলেও এ ব্যাপারে ঐতিহাসিকদের তিনটি মত পাওয়া যায়।

কেউ বলেন, এই মসজিদের প্রথম নির্মাতা হলেন আদিপিতা হজরত আদম আলাইহিস সালাম। কেউ বলেন, নুহ আলাইহিস সালোমের সন্তান সাম এই মসজিদের আদি নির্মাতা। আবার কারো মতে, হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম প্রথম এই মসজিদের ভিত্তি নির্মাণ করেন।

উমাইয়া, আব্বাসী, মামলুক, উসমানী শাসনামলে মসজিদটি মুসলমানদের অধীনে ছিল।

১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর থেকে আল-আকসা মসজিদ চত্ত্বরের ভেতরের অংশের দেখভালের দায়িত্বে পালন করে জর্ডানের ওয়াক্ফ ইসলামিক অ্যাফেয়ার্স কাউন্সিল। আর এর বাইরের এলাকার নিয়ন্ত্রণ করে ইসরায়েল।

মুসলিমদের নামাজের জন্য মসজিদটি উন্মুক্ত ছিল। ইহুদিরা এখানে সপ্তাহের নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট সংখ্যায় দর্শনার্থী হিসেবে মসজিদ কম্পাউন্ডে ঢুকতে পারতো। কিন্তু তারা প্রার্থনা করার অনুমতি পেতো না। তবে ২০২৩ সালে হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধের পর এখানে মুসলিমের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা বেড়েছে। আনাগোনা বেড়েছে ইহুদি গোষ্ঠীর। তারা এখানে নিয়মিত ধর্মাচারও পালন করতে শুরু করেছেন।

ইবরাহিমি মসজিদ

মসজিদুল আকসার পর ফিলিস্তিনের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ মসজিদের নাম হলো ইবরাহিমি মসজিদ। মসজিদটি মুসলিম জাতির পিতা খ্যাত নবী হজরত ইবরাহিম আ.-এর নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখা হয়েছে। যুগ যুগ ধরে এতে নামাজ আদায় করে আসছেন মুসলমানরা। বিভিন্ন সময় এতে নামাজ আদায়ে মুসলমানদের বাধা প্রদান করেছে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী। ১৯৯৪ সালে এই মসজিদে নামাজরত মুসল্লিদের ওপর গণহত্যা চালায় ইসরায়েল।

ইব্রাহিমি মসজিদটি পশ্চিম তীরের দক্ষিণে হেবরন শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। এখানে চার হাজার বছর আগে হজরত ইব্রাহীম (আ.)-কে সমাহিত করা হয়েছে। কিছু ঐতিহাসিকের মতে এখানে নবী ইবরাহিম আ.-এর স্ত্রী সারা, পুত্র ইসহাক, ইসমাইল আ.-এর কবর রয়েছে।

ফিলিস্তিন বিজয়ের পর ১৫ হিজরিতে মুসলমানেরা এখানে মসজিদটি নিমার্ণ করেন। উমাইয়া এবং আব্বাসীয় যুগে ক্রুসেড হামলার আগ পর্যন্ত এটি মসজিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। ক্রুসেড হামলার পর এটি ৯০ গির্জা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।

৫৮৭ হিজরিতে আল আকসা বিজেতা সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ূবি মসজিদটি পুনরুদ্ধার করেন এবং এর দেখ-ভালের জন্য ১০টি পরিবারকে নিয়োগ করেন। মসজিদের মিম্বরটি প্রাচীন ইসলামি স্থাপত্যের সাক্ষ্য বহন করছে। এটি মিসরে তৈরি করা হয়েছিল।

মসজিদটি ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত মুসলমানেদের অধীনে ছিল। ১৯৬৭ সালে ৪ জুন এতে ইসরায়েলি পতাকা স্থাপন করে দখলদার বাহিনী। এবং ১৯৯৪ সালে নামাজরত মুসল্লিদের ওপর গণহত্যা চালানো হয়।

মসজিদে ওমর ইবনুল খাত্তাব

গাজা উপত্যকায় অবস্থিত বিখ্যাত আরেকটি মসজিদ হলো খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব মসজিদ। এটি ফিলিস্তিনের গ্র্যান্ড মসজিদ হিসেবেও পরিচিত। মসজিদটি মুসলিম বিজেতাদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

মসজিদটি প্রথমে মন্দির ছিল। খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে বাইজেন্টাইনরা ফিলিস্তিন দখল করে তা গির্জায় রূপান্তর করে। সপ্তম শতাব্দীতে মুসলিমরা ফিলিস্তিন বিজয়ের পর এটি মসজিদ হিসেবে পুনর্নির্মাণ করা হয়।

দশম শতাব্দীতে মুসলিম পর্যটক ও ভূগোলবিদ ইবনে বাতুতা ফিলিস্তিনে ঐতিহাসিক এই স্থাপনাকে ‘সুন্দর মসজিদ’ আখ্যা দিয়েছিলেন।

বিভিন্ন সময়ে মসজিদটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দখলের মতো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। ১০৩৩ সালে ভূমিকম্পে এর মিনার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১১৪৯ সালে ক্রুসেডাররা মসজিদটিকে গির্জা বানায়। আইয়ুবিরা এটি উদ্ধার করে। ১৩ শতকের শুরুর দিকে মামলুক শাসকরা মসজিদটির পুনর্নির্মাণ করে। ১২৬০ সালে মঙ্গোলরা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত করে। ১৩ শতকের শেষের দিকে আরেকবার ভূমিকম্প আঘাত হানে এই মসজিদে।

ভূমিকম্পের প্রায় ৩০০ বছর পর ১৬ শতকে উসমানীয় শাসকেরা মসজিদের পুনর্নির্মাণ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বোমা হামলায় মসজিদটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ১৯২৫ সালে সুপ্রিম ইসলামিক কাউন্সিল মসজিদটি পুনরুদ্ধার করে।

সূত্র : টিআরটি, আল জাজিরা অ্যারাবিক ও মুসলিম ব্লকস

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারা নিয়ে ইসলাম যা বলে

নূর নিউজ

জমজমের পানি যেভাবে পান করা সুন্নত

নূর নিউজ

হজ নিয়ে এ সপ্তাহের জুমার বয়ানে যা বললেন আল্লামা রাব্বানী

নূর নিউজ