ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বর্তমান পরিস্থিতি

ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি কঠিন সময় ছিল, শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য নয়, বরং সমস্ত দেশবাসীর জন্য, যখন রাজা, বাদশাহ ও নবাব শাসনের অবসান ঘটে এবং ব্রিটেন তার ক্ষমতা শক্তিশালী করতে শুরু করে।

১৭৫৭ সালে ব্রিটিশদের সম্প্রসারণবাদী আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলন বঙ্গ ও মহীশূর হয়ে ১৮৫৭ সালে দিল্লিতে পৌঁছে যায় এবং মোঘল সাম্রাজ্যের জ্বলন্ত প্রদীপ সম্পূর্ণরূপে নিভে যায়। যদিও কিছু হিন্দু রাজা ও মুসলিম নবাবদের রাজ্য তখনও দেশের বিভিন্ন স্থানে রয়ে গেছে; কিন্তু কার্যত সর্বত্রই ব্রিটিশদের ক্ষমতা কায়েম হয়ে গিয়েছিল আর সেসব সরকার ছিল ব্রিটিশদের গোলাম ও দেশবাসীর মনীব।

ব্রিটিশরা রাজনৈতিক আধিপত্যের পাশাপাশি খ্রিস্টধর্মের প্রচারের জন্য একটি সংগ্রাম শুরু করে, যেনো ক্ষমতার সময়কাল দীর্ঘায়িত করা যায়, তাদের দখলকে সুসংহত করা যায় এবং ভারতকে স্থায়ীভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

যদিও খ্রিস্টান মিশনারিরা হিন্দু ও মুসলমান উভয়কেই টার্গেট করেছিল; কিন্তু হিন্দুদের নিম্ন জাতির মধ্যে তারা বেশি সফলতা লাভ করে। আর মুসলমানরা তাদের সংকল্পের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই তারা বিশেষভাবে ইসলামী বিশ্বাস, নবীজীর সত্তা ও গুণাবলী, ইসলামী ও শরীয়া আইনের উৎস কোরআন ও হাদিস এবং সেই সাথে মুসলমানদের ইতিহাসকে তারা টার্গেট বানায়।

পরিতাপের বিষয় ছিলো যে, আর্য সমাজ ও সম্প্রদায়ের লোকেরাও তাদের বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে মুসলমানদের বিরোধিতা করতে সাহায্য করেছিল। মুসলমানরা একদিকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এবং অন্যদিকে আর্য সমাজের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল।

এই পরিস্থিতিতে আল্লাহর কিছু নেক বান্দারা সহজ সমাধানের অভিনব একটি পথ আবিষ্কার করেন। সরকারকে সহায়তা করা এবং এরপরে সেই প্রভাব নিয়ে স্বাধীন ধর্মীয় মাদরাসা প্রতিষ্ঠাকরণ। তাদের অনুমান ছিলো, সুরক্ষার পাশাপাশি ইসলামের জন্য বহু জনবলও তৈরি হবে এখান থেকে, যারা পূর্ণ শক্তি এবং ধর্মীয় শ্রদ্ধাবোধের সাথে এই প্রতিষ্ঠানগুলো ইসলাম উপস্থাপন ও রক্ষার দায়িত্ব পালন করবে। সরকারের প্রভাবমুক্ত থাকার দরুন কোন পরাশক্তিই তাদের সাথে আপোস করতে পারবে না।

এই চেতনায়ই দারুল উলূম দেওবন্দ ও বিভিন্ন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ ভারতে জামিয়া নিজামিয়া ও জামিয়াতুস সালিহাত প্রতিষ্ঠা হয়। যেহেতু এই প্রচেষ্টার পেছনে আন্তরিকতার চেতনা ছিল; অতএব, এই প্রতিষ্ঠানগুলো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং এর প্রভাব কেবল ভারতেই নয়, ভারতের বাইরেও অনুভূত হয়।

দীর্ঘ ও বিস্তৃত এই দেশে এসব মাদ্রাসার মাধ্যমে তারা ইসলামী শিক্ষার হেফাজত, মুসলিম সমাজকে দ্বীনের সাথে সম্পৃক্ত রাখা, বিভ্রান্তিকর ধ্যান-ধারণা থেকে রক্ষা করা এবং ইসলামের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সন্দেহ ও আপত্তিকে খণ্ডন করার দায়িত্ব পালন করেছেন।

কাজেই এদেশে আজ যে ইসলামিক বৈশিষ্ট্য দেখা যাচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এসব সে সকল প্রচেষ্টারই প্রভাব। বর্তমান পরিস্থিতিও অনেক দিক থেকেই বৃটিশ শাসনামলের মতোই। বর্তমানে শুধু রাজনৈতিক দলই নয়, স্বয়ং সরকারও স্বঘোষিতভাবে উঠে পড়ে লেগেছে দ্বীনী মাদরাসাগুলোর পিছে। মসজিদগুলোকে মন্দিরে পরিণত করা হচ্ছে, ইসলামী স্লোগানের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে, শহর, পাড়া-মহল্লা আর রাস্তার নাম পাল্টানো হচ্ছে, দেশের ইতিহাস নতুন করে লেখা হচ্ছে।

আফসোসের বিষয় হলো, স্বাধীনতার জন্য যারা সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছে, তাদের কাছে আনুগত্যের প্রমাণ চাওয়া হচ্ছে। আলেম-উলামা ও মাদরাসাগুলো যেখানে স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রভাগে ছিলো, সেই তাদের ব্যাপারেই সন্দেহের বিজ বপন করা হচ্ছে। আপরদিকে যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে কাঁটাও পাড়ায়নি তাদের ঘোষণা করা হচ্ছে দেশের নায়ক।

তাই এটাই সত্য যে, অতীতে মাদরাসার যতটুকু প্রয়োজনীয়তা ছিলো আজ সেই প্রয়োজনীয়তা হাজারগুণ বেশি। অতএব, মাদরাসাগুলোকে রক্ষা করা, স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং আরো যুগোপযোগী করে গড়ে তোলা সমগ্র ইসলামী জাতির কর্তব্য এটা।

বর্তমানে ভারতের কয়েকটি রাজ্যে মাদরাসা সমীক্ষার নামে যা বলা হচ্ছে তার উদ্দেশ্য স্পষ্টতই মুসলমানদের লাঞ্ছিত করা এবং দেশবাসীর চোখে তাদের সন্দেহজনক করে তোলা। সরকার যদি জানতে চায় যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের আইন-শৃঙ্খলা বজায় রেখে চলছে কিনা তাহলে এটা কেবল মাদরাসাগুলোর সাথেই সম্পৃক্ত নয়। বরং তাহলে তো সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই এই সমীক্ষা চালানো প্রয়োজন, চাই সেগুলো সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের শিক্ষাকেন্দ্র হোক বা সংখ্যালঘুদের। সংখ্যালঘুদের মধ্যে, সে মুসলিম হোক বা শিখ, খ্রিস্টান বা বৌদ্ধ। উপরন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানে জরিপ ও সমীক্ষা চালানোর প্রয়োজন আরো বেশি যে, সরকারি নিয়ম-কানুন অনুযায়ী স্কুলগুলো চলছে কিনা? এগুলোর জন্য যে অবকাঠামো দেওয়া উচিত তা দেওয়া হয়েছে কি না?

এ ব্যাপারে সরকারকেও জবাবদিহি করা উচিত যে, শুধুমাত্র মুসলিম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা ধর্মীয় মাদরাসার জরিপই কেনো করা হবে? এটা তো মুসলমানদের বিরুদ্ধে সন্দেহ ও সংশয় সৃষ্টি করার নামান্তর। আর বর্তমানে যে বিদ্বেষের ঝড় বয়ে যাচ্ছে, বা আনা হচ্ছে, তাতেও সরকার সমৃদ্ধি ঘটাচ্ছে।

তাই মুসলমান এবং মুসলিম দল ও সংগঠনগুলোকে আইনের মধ্যে থেকে পূর্ণ শক্তি সঞ্চয় করে এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে; কারণ দ্বীনী মারকাযগুলো মুসলমানদের নিজস্ব সম্পত্তি। এর জমি, ভবন, আসবাবপত্র, গ্রন্থাগার ইত্যাদি কোনো কিছুতেই সরকারের কোনো অনুদান নেই।

যদি কোনো বিষয়ে অনুসন্ধান প্রয়োজন হয় তাহলে সেটা করতে পারে সরকার; কিন্তু জরিপের নামে তাদের হয়রানী করা বা মাদরাসার সম্পত্তি করায়ত্ত করার প্রচেষ্টা করে যাওয়া নিছক অন্যায় ও বাড়াবাড়ি। তাই একদিকে যেমন সরকারের এই উদ্যোগকে প্রতিহত করা উচিত, অন্যদিকে যথাযথ ব্যবস্থাও নেওয়া উচিত মুসলমানদের।

এ জাতীয় আরো সংবাদ

বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা; কী ভাবছেন বিশিষ্টজনেরা

নূর নিউজ

বৈশ্বিক সমস্যা হয়ে উঠছে ‘বিষণ্নতা’

নূর নিউজ

প্রতিবন্ধীদের অবহেলা না করে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে

নূর নিউজ