পাকিস্তানের সদ্য সমাপ্ত ১৬তম সাধারণ নির্বাচনের সবচেয়ে চমক হলো, এবারে যে বিপুলসংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ বা পিটিআইসমর্থিত প্রার্থী। কারাবন্দি ইমরানের এই দলটি নিজেদের জনপ্রিয়তা প্রমাণ করতে পারলেও সরকার গঠনের ক্ষেত্রে বড় বাধার মুখে পড়েছে।
কেননা দেশটির নির্বাচন কমিশন তাদের বিরুদ্ধে নির্বাচনি আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে দলটিকে বাতিল ঘোষণা করেছে, দলটির প্রার্থীরা তাদের দলের নির্বাচনি প্রতীক ব্যাট নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেনি। দেশটির সুপ্রিমকোর্টও এ সিদ্ধান্ত বহাল রেখেছে। দল বাতিল হওয়ার কারণেই ইমরান খানের সমর্থকরা এবারের নির্বাচনে স্বতন্ত্র হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।
এর মধ্যে ইমরান খান তিনটি মামলায় কারাবন্দি আছেন। আবার অন্য কোনো দলই এককভাবে সরকার গঠন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি।
এ অবস্থায় সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি সামনে আসছে তা হলো— পিটিআই সামনে কী করতে যাচ্ছে। পাকিস্তান নির্বাচনে এখন কী চলছে, পিটিআই এর সামনে বিকল্প কী।
জোট গঠন একমাত্র উপায়
পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনের এখন পর্যন্ত অনানুষ্ঠানিক ফল অনুসারে যেহেতু কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ফলে জোট সরকার গঠনই একমাত্র পথ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
পার্লামেন্টে ২৬৬ আসনের মধ্যে এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে ২৬৪ আসনে।
দুটি আসনের ফল অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি। কারণ এর মধ্যে একটি আসনের প্রার্থী গুলিতে নিহত হওয়ায় সেখানে নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে। আরেকটি আসনের ভোটগ্রহণ শেষ হবে এই মাসের শেষের দিকে। নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ন্যূনতম ১৩৪ আসনের প্রয়োজন।
পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটের সর্বশেষ হিসাবে দেখা গেছে, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ১০১ আসন জিতেছে। এর মধ্যে ৯৩ জনই ইমরান খান ও তার দল পিটিআইসমর্থিত প্রার্থী।
নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) ৭৫ আসন পেয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারির ছেলে বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির পাকিস্তান পিপলস পার্টি পেয়েছে ৫৪ আসন।
এ ছাড়া মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট -এমকিউএম ১৭, জামিয়তে উলেমা-ই-ইসলাম (জেইউআই-এফ) তিনটি। এবং বাকি আসন বিভিন্ন ছোট দল জিতেছে।
পিটিআইসমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সবচেয়ে বেশি আসন পেলেও সেটা এককভাবে সরকার গঠনের জন্য যথেষ্ট নয়।
কোনো দলই এককভাবে সরকার গঠন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। এ ক্ষেত্রে দলগুলোর জোট করা ছাড়া সরকার গঠনের আর কোনো বিকল্প নেই।
পিটিআইসমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য বিকল্প কী?
পাকিস্তানের নির্বাচনি আইন অনুযায়ী, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ইচ্ছা করলে স্বতন্ত্র হিসেবে জাতীয় বা প্রাদেশিক পরিষদে থাকতে পারেন।
আবার তাদের রাজনৈতিক দলে যোগদানের ক্ষেত্রে কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়ে থাকেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক রফিউল্লাহ কাকারের মতে, একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী কয়েকটি কারণে রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়ে থাকে।
প্রথমত রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে, দ্বিতীয়ত নিজেকে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে যুক্ত করতে এবং সবশেষে পার্লামেন্টে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে।
তবে বিজয়ী হওয়ার পর এই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের হাতে তিন দিন বা ৭২ ঘণ্টা সময় থাকে যে সময়ের মধ্যে তাদের কোনো একটি রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে হবে।
এবং নির্বাচন কমিশনের নিয়মানুযায়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কেবল সেই দলে যোগ দিতে পারবেন, যাদের নির্বাচনি প্রতীক ব্যালটে দেওয়া হয়েছে।
পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফকে অযোগ্য ঘোষণা করায় কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী এই দলে যোগ দিতে পারবেন না।
তাই পিটিআইকে সমর্থন দেওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কোন দলে যোগদান করবেন তা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিলাওয়াল ভুট্টো বহুবার বলেছেন তার দল নওয়াজ শরিফের পিএমএল-এন-এ যোগ দেবে না।
পিটিআইসমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিস্ময়কর সাফল্যের ফলে। তারা দুটি প্রধান বিরোধী দল অর্থাৎ নওয়াজ শরিফের দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ এবং বিলাওয়াল ভুট্টোর দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি থেকে যোগদানের প্রস্তাব পাচ্ছেন।
ওই দুই বিরোধী নেতারাও বলেছেন যে, তাদের দলে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করতে কোনো সমস্যা নেই। এখন এটি দেখার বিষয় পিটিআই এর নাম ও সমর্থন নিয়ে জয়ী হওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ইমরান খানের প্রতি অনুগত থাকেন কিনা। কারণ আইন অনুযায়ী কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী পার্লামেন্টে আসন পেলে, দলের নিয়ম মানতে তারা বাধ্য নন।
সরকার গঠনে এগিয়ে কারা
নির্বাচনের মাঠে পিটিআই এগিয়ে থাকলেও সরকার গঠনে তৎপরতা বেশি নওয়াজ শরিফের পিএমএল-এন দলের।
নির্বাচনের ফল প্রকাশের মধ্যেই লাহোরে দলের প্রধান কার্যালয়ে সমর্থকদের উদ্দেশে নওয়াজ শরিফ জোট গঠনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। এ জন্য তারা অন্যান্য দলের সঙ্গে কথা বলছেন।
এর আগে পিএমএল-এন জোট গড়েছিল পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) সঙ্গে। তাদের জোট পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) ক্ষমতায় বসেছিল।
তবে এখন জোট সরকার গঠনের ব্যাপারে পিপিপিকে সতর্ক অবস্থান নিতে দেখা যাচ্ছে।
বিলাওয়াল ভুট্টো বহুবার বলেছেন তার দল নওয়াজ শরিফের পিএমএল-এন-এ যোগ দেবে না। কেননা বিলাওয়াল সেই প্রজন্মের ভোটারদের আকৃষ্ট করতে চান, যারা পিএমএল-এনের প্রতি অসন্তুষ্ট।
তবে শেষ পর্যন্ত পিএমএল-এন এবং পিপিপি একসঙ্গে সরকার গঠন করতে পারে, এমনকি অন্যান্য দলকেও জোটে ভেড়াতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, যেহেতু এ নিয়ে আলোচনা চলছে, তাই যে কোনো কিছুই হতে পারে। এ ক্ষেত্রে পিটিআইসমর্থিত প্রার্থীরা এমন এক অবস্থায় আছে, যেখানে একটি সরকার গঠন করা বেশ কঠিন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন এ ক্ষেত্রে পিটিআইয়ের সামনে দুটি পথ রয়েছে, এক. পিটিআইপন্থি প্রার্থীরা একটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠীর আকারে থাকতে পারেন। দুই. তারা চাইলে বিলওয়াল ভুট্টোর দল বা অন্যান্য ছোট দলের সঙ্গে জোট গঠন করতে পারেন।
তবে পাকিস্তানের স্থানীয় গণমাধ্যম জিও নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পিটিআইয়ের চেয়ারম্যান গহর আলি খান জানিয়েছেন, তারা পিএমএল-এন বা পিপিপির সঙ্গে জোট গড়বে না।
আবার স্বতন্ত্র প্রার্থীরা চাইলে নিজেরা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করতে পারবেন, তবে এ জন্য তাদের ১৩৪ আসন থাকতে হবে।
তবে রফিউল্লাহ কাকার জানিয়েছেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিজেদের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করাকে বাস্তবসম্মত মনে করা হয় না, তবে নিয়ে আইনে কোনো বাধা নেই।
এদিকে পারমাণবিক অস্ত্রসমৃদ্ধ দেশ পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর বড় প্রভাব রয়েছে। সে হিসাবে এবারের নির্বাচনে সেনাবাহিনীর পছন্দের প্রার্থী নওয়াজ শরিফ পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সরকারে থাকলে ইমরান খানের কারাদণ্ড বা তার সরকারি দায়িত্বে থাকার ওপর নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে আইনি লড়াই করতে পারবে।
সংরক্ষিত আসন পেতে অযোগ্য, মামলায় কোণঠাসা পিটিআই
পাকিস্তানের পার্লামেন্টে ৭০ সংরক্ষিত আসন রয়েছে। এই আসনগুলো বিভিন্ন দলকে তাদের শক্তি অনুযায়ী বণ্টন করা হয়। অর্থাৎ যে দল যত বেশি আসনে জয় পাবে, তার দল তত বেশি সংরক্ষিত আসন পাবে। সে হিসেবে নওয়াজ শরিফের দল ২০টির বেশি আসন পেতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে পাকিস্তানের নির্বাচনি আইনের অধীনে, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পার্লামেন্টের ওই ৭০টি সংরক্ষিত আসন বরাদ্দ পাওয়ার যোগ্য নন। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সরকার গঠনের ক্ষেত্রে এটাই সবচেয়ে বড় অসুবিধা। এ ক্ষেত্রে পিটিআইয়ের সামনে একটি পথ হলো নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী কোনো দলে যোগ দেওয়া।
এদিকে রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা ফাঁস, দুর্নীতি, বেআইনি বিয়ের মতো অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়ে প্রায় ১০ মাস ধরে কারাগারে ইমরান খান। তিনটি মামলায় ২৪ বছর সাজা হয়েছে তার। কারাগারে থাকাকালীন কোনো সরকারের অংশ হতে পারবেন না তিনি।
এমন পরিস্থিতিতেও প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী নওয়াজ শরিফের দল ও বিলাওয়াল ভুট্টোর দলকে পেছনে ফেলে সর্বোচ্চ আসনে জয়ী হয়েছেন ইমরান খানের দল পিটিআইসমর্থিত প্রার্থীরা।
বিশ্লেষকদের অনেকের অভিমত, স্বতন্ত্র এই প্রার্থীরা যদি কোনোভাবে সরকারে থাকেন, তা হলে মি. খানের কারাদণ্ডের সাজা বা তার সরকারি দায়িত্বে থাকার ওপর নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে আইনি লড়াই করতে পারবেন।
একই সঙ্গে নির্বাচনে অংশগ্রহণে ইমরান খানের ওপর নিষেধাজ্ঞার যে সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশন নিয়েছে, সেটিকেও চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন এই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
সূত্র : বিবিসি বাংলা।