আদ জাতি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর যে কয়েকজন মুমিন জীবিত ছিলেন, তারা কৃষ্ণসাগরের কূলঘেঁষা হেজাজ ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী এক অঞ্চলে চলে যান।
কুরআনে তাদের বলা হয়েছে ‘সামুদ জাতি’। যেহেতু তারা স্থাপত্যশিল্পে পারদর্শী ছিলেন, ওই অঞ্চলেও পাথর কেটে বাড়ি বানান। সময় গড়ায়, ছেলে-সন্তান বড় হয়, জওয়ানেরা বুড়ো হয়, আল্লাহর আজাবের সাক্ষী মুমিনগণ একে একে ইন্তেকাল করেন।
কয়েক প্রজন্ম পরে শয়তানের ধোঁকায় তারা আবার শিরক করতে শুরু করে, যেসব কারণে প্রথম আদ জাতি ধ্বংস হয়েছিল—তার সবই করতে থাকে।
আল্লাহতায়ালা তাদের সতর্ক করার জন্য হজরত সালেহকে (আ.) পাঠান। তিনি বললেন, ‘হে আমার জাতি, তোমরা আল্লাহর এবাদত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো ইলাহ নাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘তোমরা স্মরণ কর, যখন আল্লাহ আদ জাতির পরে তোমাদেরকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেন এবং পৃথিবীতে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে, তোমরা সমতল ভূমিতে প্রাসাদ ও পাহাড় খোদাই করে বাড়ি নির্মাণ করেছ। সুতরাং তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর এবং পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করে বেড়িয়ো না।’
কিছু মানুষ তার দাওয়াত শুনে মূর্তিপূজা ছেড়ে দিলেন, এক আল্লাহতে বিশ্বাস আনলেন। কিন্তু অহংকারী নেতাগণ ঈমান আনতে অস্বীকৃতি জানালো, তারা সাধারণ মুমিনদের উদ্দেশ্য করে বলল, ‘তোমরা যার প্রতি ঈমান এনেছো, আমরা তাকে অস্বীকার করি।’ (সুরা আ’রাফ, আয়াত ৭৩, ৭৪ ও ৭৬)
হযরত সালেহ (আ.) নিরন্তর দাওয়াতি কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। সামুদ জাতির নেতৃবৃন্দ নানাভাবে তাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু তিনি আল্লাহর হুকুম পালনে অবিচল থাকেন। এভাবে অনেক বৎসর পেরিয়ে যায়, সালেহ (আ.) বৃদ্ধ হয়ে যান।
কাফেরেরা যখন দেখল তাকে কোনোভাবেই নিরস্ত করা যাচ্ছে না, তখন অদ্ভূত এক আবদার করে বসল। তারা ভেবেছিল হযরত সালেহ (আ.) কখনোই এই আবদার পূরণ করতে পারবে না, এর পরে তাদের আর দাওয়াতও দেবে না।
তো তারা হজরত সালেহকে (আ.) বলল, আপনি সত্যি সত্যিই আল্লাহর পয়গম্বর হন, তাহলে ওই পাহাড় থেকে একটি স্বাস্থ্য-সবল ও দশ মাসের গর্ভবতী উট বের করে দেখান।
সালেহ (আ.) প্রথমে তাদেরকে অঙ্গীকার করতে বললেন—যদি আমি তোমাদের আবদার পূরণ করি, তবে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে। তারা সবাই অঙ্গীকার করল।
এরপর সালেহ (আ.) আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন, ‘মালিক, আপনার জন্য কোনো কিছুই কঠিন নয়, আপনি তাদের আবদার পূরণ করে দিন।’ এমন সময় বিকট শব্দে পাথর ভেঙে, তারা যেমন দাবি করেছিল ঠিক তেমন একটি উট বের হয়ে আসল। এই বিস্ময়কর মোজেজা দেখে তৎক্ষণাৎ সবাই ঈমান আনতে যাচ্ছিল, কিন্তু ঠিক তখনই তাদের নেতৃবৃন্দ এসে বাধা দেয়। অল্প কয়েকজনই শুধু তাদের কথা অগ্রাহ্য করে ঈমান আনে।
সালেহ (আ.) বললেন, এটি আল্লাহর উট—তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শন, এটি একদিন পরপর পানি পান করবে। উটটি এতবেশি পানি পান করত যে, অন্য প্রাণীর খাবারের জন্য কোনো পানি থাকত না। মূলত এটাও ছিল আল্লাহর আজাব। অবশেষে তারা উটটিকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়।
শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি (রহ) বলেন, ‘মানুষ যে পাপকাজ করে, আলমে মালাকুতে সেই পাপকাজটা কোনো পশুর আকৃতি ধারণ করে থাকে।… সামুদ জাতির পাপকাজ এতই বেড়ে গেছিল, সেটা বিশাল মাদি উটের রূপ লাভ করে। তারা যখন উটটিকে হত্যা করে, তখন পাপকাজ আল্লাহর আজাব হয়ে ছড়িয়ে পড়ে।’ (তাওয়িলুল আহাদিস, শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি, পৃষ্ঠা ২১-২২)
তারা যখন উটটিকে হত্যা করে, হযরত সালেহ (আ.) অশ্রুভরা চোখে তার জাতিকে বললেন, ‘হে দুর্ভাগা জাতি, তোমরা কি ধৈর্য ধরতে পারলে না? এখন আল্লাহর আজাবের অপেক্ষায় থাকো।’ এর তিনদিন পর অবধারিত শাস্তি আসে—এক বিকট আওয়াজ হয়, সেই আওয়াজে যে যেই অবস্থায় ছিল সেই অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করে। (কাসাসুল কুরআন, মাওলানা হিফযুর রহমান সিওহারবি, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৬৬)
আল্লাহর নির্দেশে সালেহ (আ) মুমিনদের নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। আজাব শেষে সালেহ (আ) আপন জাতির জনশূন্য ঘরবাড়ি দেখে দুঃখভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলে উঠেন, ‘তোমাদের নসিহত করেছিলাম, কিন্তু তোমরা তো নসিহতকারীদের পছন্দ করো না।’ (সুরা আ’রাফ, আয়াত ৭৯)