গণপরিবহনে নারীদের শ্লীলতাহানির ঘটনা বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে সকালে ও অফিস শেষে ফেরার সময় নারীরা গণপরিবহনে উঠতে গেলেই তারা এ ধরনের বিড়ম্বনায় পড়েন। অনেক নারী এটি মুখ বুজে সহ্য করলেও মাঝেমধ্যে অনেকেই প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন।
ভুক্তভোগী নারীরা বলছেন, রাজধানীতে শুধু যে কর্মজীবী নারীরা এ ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন তা কিন্তু নয়; স্কুল-কলেজ পড়ুয়া মেয়েরাও এ ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন। রাজধানীতে নারীদের জন্য পৃথক বাস সার্ভিস চালু হলেও বর্তমানে এখন আর সেটি দেখা যাচ্ছে না। রাজধানীতে নারীদের পৃথক বাস চালু করলে এই সমস্যার সমাধানও হবে বলে অনেকেই মনে করছেন।
নারী নেত্রীরা বলছেন, সড়কে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা কমাতে নানা পর্যায় থেকে বিভিন্ন দাবি-পরামর্শ উপস্থাপিত হলেও আড়ালেই থেকে যাচ্ছে গণপরিবহনে চলাফেরায় নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি। নারীবান্ধব যানবাহন না থাকায় তাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের বড় কারণ। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে নারীবান্ধব যানবাহন, চালক ও সহকারী থাকতে হবে। পরিবর্তন আনতে হবে যাত্রীদের মানসিকতায়ও।
গত বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটার দিকে রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় দেখা যায় অনেক লোকের জটলা। কাছে গিয়ে জানা যায়, বাসের মধ্যে এক তরুণীকে শ্লীলতাহানি করার কারণে ওই ব্যক্তিকে ধরে রেখেছে লোকজন। বাসেই শ্লীলতাহানি করার কারণে ওই তরুণী লোকজনকে বলায় ওই ব্যক্তিকে বাস থেকে নামিয়ে আনা হয়েছে। লোকজন তাকে উত্তম-মধ্যমও দেয়। পরে ভাটারা থানা পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয় ওই ব্যক্তিকে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক নারী বলেন, রামপুরা থেকে প্রতিদিন গুলশান ২-এ যেতে হয়। তিনি লোকাল বাসে যাতায়াত করেন। ভিড়ের মধ্যে উঠতে গিয়ে প্রতিনিয়ত তাকে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।
তিনি বলেন, আসলে এরকম অবস্থায় কিছু বলাও যায় না। তবে নারীদের জন্য পৃথক বাস চালু থাকলে এ সমস্যায় পড়তে হয় না। এটি চালু করতে হবে সব রুটেই।
ভুক্তভোগী আরেকজন বলেন, বাসে নারীদের জন্য যে নির্ধারিত আসন থাকে, তার অধিকাংশেই পুরুষরা বসে থাকে। আবার দেখা যাচ্ছে, নারীর জন্য যে জায়গাটুকু সেটিও পরিপূর্ণ হয়ে থাকে। এ অবস্থায় আমাদের দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না।
ওই ভুক্তভোগী আরো বলেন, অনেক সময় প্রতিবন্ধকতাও ঘটে। এগুলো আসলে বলাও যায় না। সবকিছু সহ্য করেই চলতে হচ্ছে। কিছুদিন আগে দোলনচাপা নামের মহিলা বাস থাকলেও এখন নেই। যার কারণে নারীরা গণপরিবহনে এ অবস্থার মধ্যেই চলছে।
নারীদের জন্য দ্রুত বাস সার্ভিস চালুর দাবি জানান তিনি।
সম্প্রতি প্রকাশিত ব্র্যাকের ‘নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় ৯৪ শতাংশ নারী ইভটিজিং, শারীরিক বা অন্য কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ৪১ থেকে ৬০ বছর বয়সী পুরুষদের দ্বারাই যৌন হয়রানির শিকার হন বেশিরভাগ নারী, যার হার ৬৬ শতাংশ। নারীদের যৌন হয়রানির মূল কারণ হচ্ছে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ না থাকা, বাসে অতিরিক্ত ভিড়, যানবাহনে পর্যাপ্ত আলোর অভাব ইত্যাদি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শারীরিকভাবে যৌন হয়রানির শিকার শূন্য ক্ষেত্রে ৮১ শতাংশ নারী বলেছেন তারা চুপ থাকেন এবং ৭৯ শতাংশ বলেছেন আক্রান্ত হওয়ার স্থান থেকে সরে যান।
এ ব্যাপারে ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভার্সিটি প্রোগ্রামের জেন্ডার স্পেশালিস্ট হোসনে আরা বেগম বলেন, সমান অধিকারের কথা বললেও সমঅধিকার নীতি এখনো আমরা করতে পারিনি। শুধু গণপরিবহন নয়, নারীর চলাচলের সবদিকই আমাদের ভাবতে হবে। গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তার কথা বলছি; কিন্তু পরিবহনে হয়রানির পর শুধু কয়েকটি সংগঠন বা কয়েকজন নারীই প্রতিবাদ করেন। স্বাধীনভাবে গণপরিবহনে চলাচলের ক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিভিন্ন পরিবহন সংস্থা বা ধর্মীয় সংগঠনের এগিয়ে আসা উচিত।
সম্প্রতি বেসরকারি সংগঠন অ্যাকশন এইডের একটি জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বড় শহরগুলোতে দিনে যৌন হয়রানি থেকে শুরু করে নানারকম হেনস্তার শিকার হন নারী যাত্রীদের একটা বড় অংশ। বাসে পুরুষ যাত্রীদের মাধ্যমে ৪২ শতাংশ ও পরিবহণ সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে যৌন হয়রানির শিকার হন ৫৩ শতাংশ নারী যাত্রী।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট বগুড়ায় পরীক্ষা দিয়ে বাসে কর্মস্থল ময়মনসিংহে যাবার পথে জাকিয়া সুলতানা রূপা নামে এক কলেজছাত্রীকে গণধর্ষণের পর হত্যা করে গাড়ির চালক, তার সহকারী ও সুপারভাইজার। ঘটনার পরে রূপার লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত শেষে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে টাঙ্গাইলে দাফন করা হয়। রূপা ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ২০১৮ সালে বাসের চালক এবং সহকারীসহ চারজনের ফাঁসির আদেশ দেয় আদালত।
২০১৯ সালের ১০ আগস্ট রাতে চট্টগ্রাম মহানগরে চলন্ত বাসে এক গৃহবধূকে ধর্ষণের চেষ্টার ঘটনা ঘটে। তবে সেই নারীর চিৎকার শুনে পেছনে থাকা গরুবোঝাই একটি ট্রাকের চালক বাসটির গতিরোধ করেন। এরপর স্থানীয় লোকজন বাসের চালক ও তার সহকারীকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।
আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানায় কাজ শেষে জামালপুরে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য বাস ধরতে গত বছরের ২৪ জানুয়ারি শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় যান এক পোশাককর্মী। সেখানে এক পিকআপ ভ্যানের চালক নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার কথা বলে ওই পোশাককর্মীকে তুলে নেন। পরে চালক ও হেলপার মিলে তাকে ধর্ষণ করে ফেলে যায় রাস্তায়।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, রাস্তাঘাট, গণপরিবহনসহ সর্বত্র উদ্বেগজনকভাবে নারী ও শিশু নির্যাতনের ভয়াবহতা বেড়েছে। নারীরা স্বাধীন চলাফেরায় অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ছে।
এ অবস্থার উত্তরণের জন্য ধর্ষণের বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহনশীলতা’র নীতি গ্রহণ ও দ্রুত কার্যকরে প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে জোর দাবি জানান তিনি।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম বলেন, ধর্ষণ, শ্লীনতাহানি কিংবা যৌন হয়রানি রোধে অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল জোরদার করার পাশাপাশি নারীর চলাচল নিরাপদ করার লক্ষ্যে গণপরিবহনে সিসি ক্যামেরা স্থাপনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং পরিবহন মালিক সমিতিকে।
এ বিষয়ে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি কিন্তু সবক্ষেত্রেই বিঘ্নিত হচ্ছে, কারণ নৈতিকতার অধঃপতন। এই জায়গায় আমাদের জোরালোভাবে কাজ করতে হবে। নারীদের পরিবহন সেক্টরে বেশি করে আনা গেলে গণপরিবহনে নারীর চলাফেরা সাহসী হবে।