জ্ঞান অন্বেষণে বিয়ে করেননি যেসব মুসলিম বিজ্ঞানীরা

জীবনোপলব্ধি জনে জনে আলাদা, রূঢ় বাস্তবতা ও ঐকান্তিক অবস্থান দারুণ কটাক্ষের কারণ হলেও অসম্ভব কিছু নয়। সংসারজগৎ তৈরির অবসর উঁকিঝুঁকি দেয়নি, এমন বিস্ময়কর ব্যক্তিত্বের তালিকা যেমন দীর্ঘ, তেমনই তাঁদের জীবনের গল্প ব্যক্তিগত বলয় পেরিয়ে ইতিহাসের অংশ। ঈসা (আ.) সম্পর্কে একটি ঘটনা আহমেদ ইবনে হাম্বল (রহ.) তাঁর ‘কিতাবুজ জুহদে’ লিখেছেন। একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘আপনি বিয়ে করেননি কেন?’ তিনি বলেন, ‘মরণশীল স্ত্রী দিয়ে আমি কী করব?’বিয়ে করা ‘সুন্নত’। সামর্থ্যবানদের প্রিয় নবী (সা.) বিয়ে করতে বলেছেন। তিনি বিয়ের ফজিলত ও উত্তম স্ত্রীর বরকতের কথা বলতেন। তবে আর্থিক সংগতি না থাকলে প্রিয় নবী (সা.) সিয়ামের পরামর্শ দিতেন। বিয়ে ইলম সাধনা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। এ সম্পর্কে সতর্ক করে ওমর (রা.) বলেছিলেন, ‘বিয়ে আর নেতৃত্ব গ্রহণের আগে তোমরা জ্ঞানার্জন করো।’

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) লেখেন, ‘ইলম অর্জনের আগে নারীর সোহাগ থেকে দূরে থাকো। এতে তোমার সময় নষ্ট হবে। পুত্র-কন্যা হবে। তুমি তাদের প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টায় লিপ্ত হবে। আর এভাবে ইলম থেকে দূরে থেকে যাবে।’সুফিয়ান আস-সাওরি (রহ.) উপমা দিয়েছেন, ‘বিয়ে করা মানে নৌকায় চড়া। আর সন্তান হওয়া অর্থ নৌকার তলা ফেটে যাওয়া, যা পানিতে তলিয়ে যাবে যেকোনো মুহূর্তে। এ জন্যই ইমাম আহমেদ ইবনে হাম্বল (রহ.) ৪০ বছর বয়সে বিয়ে করেন। এটা তিনি করেন, ইলম অর্জনের জন্য।

জারির আত তাবারি (রহ.) হচ্ছেন সবচেয়ে সেরা তাফসিরের রচয়িতা। তিনি ৩০ হাজার পৃষ্ঠার একটি তাফসির লেখার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। ছাত্ররা ভয় পেয়ে যাওয়ায় তিন হাজার পৃষ্ঠার তাফসির লেখেন। জারির আত তাবারি (রহ.) চিরকুমার ছিলেন। আবু বকর আল আম্বারি (রহ.) সনদসহ ১২০টি তাফসির মুখস্থ বলতে পারতেন। কোরআনুল কারিমের অর্থ ও মর্ম জানার জন্য তিন লাখ কবিতার পঙক্তি মুখস্থ করেছিলেন। অবিবাহিত ছিলেন তিনিও। বউয়ের সঙ্গে নয়, বিধাতার নিবিড় সান্নিধ্য-সাধনা ও বইয়ের সঙ্গে সংসার পেতে অনেকে হয়েছেন ইতিহাসখ্যাত।

চিরকুমার আলেমদের নিয়ে স্বতন্ত্র বই আছে। লিখেছেন শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ (রহ.)। আরবি ভাষায় রচিত বইটির নাম ‘আল-উলামাউল উজ্জাব’। বাংলা ভাষায় অনূদিত নাম : ইলমের ভালোবাসায় চিরকুমার উলামায়ে কেরাম। তবে লেখক ইলমের ভালোবাসায় চিরকুমার সব আলেমের জীবনী আলোচনা করেননি, বরং একজন শায়খাহসহ ৩৫টি জীবনী স্থান পেয়েছে এই গ্রন্থে। বিশর হাফি, আবু আলি ফারসি, আবু জাফর তবারি, ইবনুল আনবারি, আবুল কাসেম যমখশরি, ইমাম নববি, ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ (রহ.) যুগশ্রেষ্ঠ মুসলিম মনীষীদের নাম যুক্ত হয়েছে এই চিরকুমার আলেমদের তালিকায়।‘ইসলামে বৈরাগ্য নেই—এটা জেনেও অনেক মহাপুরুষ বেছে নিয়েছিলেন জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও আধ্যাত্ম সাধনার ঘরবসতি। একা থাকতেও যোগ্যতা লাগে। হয়তো একাকিত্বের মাঝেই কেউ কেউ জীবনের অমূল্য সুখ খুঁজে পেয়েছেন, অবিবাহিত হওয়াটিই হয়তো তাঁদের করেছে মহান। শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমি, শাহজালাল, হাজি মোহাম্মদ মোহসিন, বায়তুল মোকাররমের প্রথম খতিব আল্লামা আবদুর রহমান কাশগরি প্রমুখ (রহ.) ছিলেন অবিবাহিত।

বস্তুত সন্তানদের মাধ্যমে পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে চায় মানুষ। অথচ সাধক মহামানব ও জ্ঞানতাপসদের কাছে বই-ই তাঁদের সন্তান। জ্ঞানের পত্ররস তাঁদের কাছে প্রেয়সীর গোলাপি গালের চেয়েও মধুময়। তবু তাঁরা কিন্তু বিয়ে ফরজ এটা অস্বীকার করেননি এবং কাউকে বিয়ে করতে নিষেধ করেননি। মহান আল্লাহর নির্দেশ—‘যাদের বিয়ের সামর্থ্য নেই, আল্লাহ তাদের নিজ অনুগ্রহে অভাবমুক্ত না করা পর্যন্ত তারা যেন সংযম অবলম্বন করে।’ (সুরা : নুর, আয়াত : ৩৩)

এ সামর্থ্য বলতে যেমন আর্থিক-শারীরিক সামর্থ্য বোঝায়, তেমনই সংযমের কারণ হতে পারে জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক সাধনা এবং ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা ও রহস্য। কেননা মানুষ তো চাঁদের মতো, যার একটা অন্ধকার দিক থাকে, যা সে দেখাতে চায় না।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, কাপাসিয়া, গাজীপুর

এ জাতীয় আরো সংবাদ

তুরস্কে পৌঁছেছে বাংলাদেশের উদ্ধারকারী দল

নূর নিউজ

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদের নিশ্চিয়তা ছাড়াই সুইডেনের ন্যাটো সদস্যপদ নিয়ে আপত্তি তুলে নিলো এরদোয়ান

নূর নিউজ

কাতারে ইসলাম জানছে অমুসলিমরা, আসছে চিন্তার নানা পরিবর্তন

নূর নিউজ