• ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন
উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয়েছিল মাদরাসা শিক্ষা দিয়ে। অনেকেই অনেক কিছু মনে করতে পারেন। তবে আমি মনে করি, ধর্মীয় অনুভ‚তির বাইরে আমরা কেউ না। আমরা ধর্মকে অস্বীকার করতে পারি না।
আবার ধর্মের অপব্যবহার হোক, এটাও আমরা চাই না। জীবন-জীবিকার শিক্ষার পাশাপাশি যখনই আমরা ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি, তখনই শিক্ষা পূর্ণাঙ্গ হয়।’ (যুগান্তর : ৪ অক্টোবর, ২০১৮) প্রধানমন্ত্রীর এসব বক্তব্য যুক্তিসিদ্ধ ও ইতিহাসনির্ভর। এর তাৎপর্য ও গুরুত্ব বিশ্লেষণের দাবি রাখে। সরকারের কিছু দায়িত্বশীল ব্যক্তি মাঝে মধ্যে মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেন এবং ইসলামী শিক্ষাকে সঙ্কুচিত করার প্রবণতা লালন করেন। কওমি মাদরাসাগুলোকে সরকারের নিয়ন্ত্রণের নেয়ার কথাও শোনা যায় তাদের বক্তব্যে। এটি প্রধানমন্ত্রীর উপলব্ধি ও মননশীলতার সাথে সাংঘর্ষিক। আমরা সবসময় বলে আসছি, ধর্মের সাথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতার কোনো বিরোধ নেই।
প্রধানমন্ত্রীর প্রথম ঘোষণার ১২ বছর হতে চলল, কিন্তু এ ঘোষণা আজো বাস্তবায়িত হয়নি, নেয়া হয়নি কোনো কার্যকর পদক্ষেপ। প্রধানমন্ত্রীর অনেক ঘোষণা এরই মধ্যে আলোর মুখ দেখেছে। অ্যাফিলিয়েটিং আরবি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, বিপুল স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার এমপিওভুক্তি, প্রতিটি উপজেলায় বেসরকারি কলেজকে জাতীয়করণ, কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিস সনদের মাস্টার্সের স্বীকৃতি, এনটিআরসিএর মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে ৩৮০টি মক্তব চালু, সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ বর্তমান সরকারের ইতিবাচক অর্জন। এ ছাড়া ২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০-এর ১৫টি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল ‘ধর্ম ও নৈতিকতার ওপর সঠিক শিক্ষা প্রদান’।
পর্যাপ্ত ধর্মশিক্ষকের অভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকার প্রাইমারি স্কুলে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। অনেক স্কুলে হিন্দু শিক্ষকরা পড়াচ্ছেন ইসলাম ধর্মশিক্ষা। কারণ ওই সব স্কুলে কোনো মুসলমান শিক্ষক নেই। অন্য দিকে একই কারণ ও পরিস্থিতিতে মুসলিম শিক্ষকরা পড়াচ্ছেন হিন্দু ধর্মশিক্ষা। কিছু স্কুলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শিক্ষকের অভাবে ধর্মশিক্ষার ক্লাসও নিয়মিত হয় না। দায়সারা গোছের পাঠদানের ফলে কোমলমতি শিশুরা ধর্মের মর্ম উপলব্ধি ও নৈতিকতার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী, মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে ১৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইসলাম ধর্ম পড়াচ্ছেন হিন্দু শিক্ষক। কোথাও বা বছরের পর বছর ধরে ‘ইসলাম শিক্ষা’ পাঠদান ব্যাহত। রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দির বারুগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১২ বছর ধরে ‘ইসলাম শিক্ষা’ ক্লাস নিচ্ছেন হিন্দু শিক্ষক। বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান গুরুত্ব পেলেও ইসলাম শিক্ষা উপেক্ষিত। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ধর্মীয় শিক্ষাকে আমরা যতই উপেক্ষা করছি, ততই বাড়ছে মাদকাসক্তি। এর নেতিবাচক প্রভাব সরাসরি পড়ছে দেশের সব সেক্টরে। ধর্মীয় শিক্ষা না থাকায় দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশকে মাদক গ্রাস করে নিয়েছে। (যুবায়ের আহমাদ, কালের কণ্ঠ, ঢাকা, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯) মন্ত্রণালয় বা অধিদফতরের কোনো নির্দেশনা না থাকার অজুহাতে জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা শিক্ষক বদলি ও পোস্টিংয়ে ধর্মশিক্ষার ব্যাপারটি বিবেচনায় আনছেন না। বিশ্বাস, বোধ ও চর্চার বাইরে যে কেউ ধর্মশিক্ষা দিতে গেলে তা যথার্থ হয় না; শিক্ষার্থীদের ওপর তার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে না। এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মর্মকথা পড়াতে গেলে বিকৃতি ও বিভ্রান্তি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। প্রতি বছর বিপুল শিক্ষার্থী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড থেকে কামিল ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি, ইসলামিক স্টাডিজ, দাওয়াহ ও কুরআনিক সাইন্স ডিসিপ্লিন থেকে মাস্টার্স এবং কওমি মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রি নিয়ে বেরোচ্ছেন। তাদের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে ধর্মশিক্ষক নিয়োগ করা হলে সঙ্কট উত্তরণের পথ সহজ হবে।
প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিটি শিশুর প্রধান ও মৌলিক অধিকার। এটি শিশুর চরিত্র গঠনের প্রথম ধাপ। প্রাথমিক শিক্ষার ভ‚মিকা হলো শিশুর বিস্তৃত শিক্ষা নিশ্চিত করা। এর মধ্যে রয়েছে সামাজিক, শাস্ত্রীয়, সাংস্কৃতিক, মানসিক ও শারীরিক দক্ষতার বিকাশ। ধর্মশিক্ষার অভাবে শিশু বয়সেই অনেকে নৈতিকতা হারিয়ে অন্যায় অপকর্মের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। সমাজে বাড়ছে শিশু অপরাধ। নেশাজাতীয় দ্রব্যের প্রতিও আসক্ত হচ্ছে তারা। ধর্ম সম্পর্কে শেখা এবং ধর্ম থেকে শেখা সব শিক্ষার্থীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ধর্মীয় শিক্ষা ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের এবং অন্যদের বোঝার ব্যাপারে সাহায্য করে। এটি ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক, নৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশধারাকে ত্বরান্বিত করে থাকে।
ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা একটি শিশুকে মানবতা, ভালো আচরণ এবং অন্যদের সাথে কিভাবে আচরণ করতে হয় তা শিখতে সাহায্য করে। শৈশবকালে শিক্ষার গুরুত্ব আরো বেশি; কারণ এটি শিশুদের সামাজিক ও মানসিক দক্ষতা বিকাশের জন্য সুযোগ্য সময়; যা তাদের বৃদ্ধি ও সাফল্যে সহায়তা করবে। আদর্শবাদ অনুসারে শিক্ষার লক্ষ্য ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি এবং স্থানে স্থানে সংস্কৃতির চর্চা, প্রচার ও সংরক্ষণের সাথে সম্পর্কিত হওয়া উচিত। আদর্শিক শিক্ষা মানুষের নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও নান্দনিক ক্রিয়াকলাপ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধ সংরক্ষণ ও বিকাশে সহায়তা করে।
শিক্ষা হলো মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের উপলব্ধি এবং শরীর ও আত্মার সমন্বয়। শিক্ষা অবশ্যই নৈতিকতা ও নীতিজ্ঞানের ভিত্তিতে হওয়া উচিত। নীতিবোধ ও নৈতিকতা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মানুষের সব চিন্তা, কাজ ও আচরণ এই দু’টি ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। নৈতিক শিক্ষা সঠিক ও ভুলের মধ্যে পার্থক্য করতে সাহায্য করে; ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন ঘটায়; ব্যক্তি ও পেশাগত জীবন গড়ে তুলতে সাহায্য করে; জীবন থেকে হিংসা, অসততা, ঈর্ষা প্রভৃতি সমস্য