ফিলিস্তিনি শিশুদের কি অপরাধ?

ইহুদীবাদী ইসরাইলী হামলায় একে একে প্রায় ৬০ শিশু মারা গেছে মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে। আর আহত হয়েছে শত শত শিশু। শিশুর আর্তনাদে কাঁদছে আকাশ বাতাস। আতঙ্কিত যে শিশু মায়ের বুকে আশ্রয় খুঁজে ঘুমের দেশে হারিয়ে গিয়েছিল, ভোরে সে লাশ। থেঁতলে গেছে তার শরীর। তেমনি মায়ের কোলে শুয়ে আছে। সবাই নিথর। পরিবারের কেউ বেঁচে নেই ইসরাইলি নৃশংসতার থাবায়। এ লাশ দেখে, শিশুদের এমন অকারণ মৃত্যু দেখে ক্ষোভে জ্বলছে গাজার মানুষ। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ বিক্ষোভ হচ্ছে।

যুদ্ধের নামে এভাবে শিশু হত্যা, বেসামরিক মানুষকে হত্যা- কোনো আইন দিয়ে এর বৈধতা দেয়া যায়! বিশ্ববাসী তবু যেন দর্শক। যারা এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন, তারা বলছেন- ইসরাইলেরও আত্মরক্ষার অধিকার আছে। কিন্তু এর যুঁৎসই জবাব দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ভারমন্টের সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স। তিনি বলেছেন, হামাসের রকেট হামলার জবাব দিচ্ছে ইসরাইল। কিন্তু হামাস কেন রকেট হামলা চালায় সেই কারণটিতে যেতে হবে আগে।

এ অবস্থায় কথার চেয়ে অধিক দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে বিভিন্ন দেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ সত্যয়ে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকের পর তিনি বলেছেন, খোলা মনে বলছি- এটা যথেষ্ট নয়। জাতিসংঘকে অবশ্যই একটি রেজ্যুলুশন দিতে হবে। তাতে বর্ণনা থাকতে হবে যে, ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে যেসব ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে তা বেআইনি এবং অবৈধ। এ সময় তিনি ইসরাইলের বিরুদ্ধে অবরোধ দেয়ার আহ্বান জানান। মোহাম্মদ সত্যয়ে তার দেশের মিত্রদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ইসরাইলের রাষ্ট্রদূতদের তলব করতে এবং তাদেরকে জানিয়ে দিতে যে, ইসরাইলের সঙ্গে তারা বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থগিত করবেন। ইসরাইল মানবাধিকারের প্রতি সম্মান না দেখানো পর্যন্ত জাতিসংঘ ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে আসা সহায়তা বন্ধ করে দেবেন। রক্তের মধ্যে যে শিশু নিথর হয়ে পড়ে আছে, যে শিশু জীবনের অর্থ বোঝার আগে প্রাণ হারালো- আন্তর্জাতিক আইনে এটা ক্রাইম। এর শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু ইসরাইলকে হত্যাকাণ্ডের লাইসেন্স নবায়ন করা হয়েছে। অবিলম্বে তা বন্ধ করতে হবে।

ধ্বংসলীলার শিকার গাজার শিশু। নিরপরাধ শিশুর রক্তে ভিজে যাচ্ছে মাটি। একটি দুটি নয়, কমপক্ষে ৫৮টি শিশুর রক্তে হাত রক্তাক্ত করেছেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। সেভ দ্য চিলড্রেনের হিসাবে, প্রতি ঘণ্টায় গাজায় আহত হচ্ছে কমপক্ষে তিনটি শিশু। এ অবস্থায় বুকের ভেতরে আর্তনাদ উঠেছে সেভ দ্য চিলড্রেন ফিলিস্তিন পরিচালক জ্যাসন লি’র। তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পদক্ষেপ নেয়ার আগে আর কতো পরিবারকে তার প্রিয়জন হারাতে হবে? যখন বাড়ির উপরে বিমান থেকে বোমাবৃষ্টি হয়, তখন শিশুরা কোথায় আশ্রয় নেবে? গাজার পরিবার এবং সেভ দ্য চিলড্রেনের স্টাফরা বলছেন, পরিস্থিতি ব্রেকিং পয়েন্টে। তারা বসবাস করছেন নরকে। আশ্রয় নেয়ার মতো কোনো স্থান নেই। গাজায় ইসরাইলের অসম শক্তি প্রদর্শনে সবকিছু মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। রেহাই পাচ্ছে না শিশুরাও। কিন্তু কেন? হামাসকে শায়েস্তা করার নামে বেসামরিক লোকজনের ওপর কেন এই নৃশংসতা? কেন বেসামরিক লোকজনের বাড়ি, মিডিয়া হাউজ গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। শিশুর আর্তনাদে আশেপাশের মানুষ হাউমাউ করে কাঁদছেন। ইসরাইল হামাস ধ্বংসের নামে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে জনপদ, বিশাল বিশাল টাওয়ার। এমনকি তাদের রক্তের নেশা থেকে রেহাই পাচ্ছে না স্কুল পর্যন্ত। কমপক্ষে ৩১টি স্কুল ধ্বংস করে দিয়েছে। এরপরও জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ রোববারের বিশেষ বৈঠকে কোনো যৌথ বিবৃতি দিতে পারেনি। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা। এ অভিযোগ চীনের। এ থেকে স্পষ্ট যে, ইসরাইলি নৃশংসতায় সমর্থন আছে যুক্তরাষ্ট্রের। তাই তারা যা খুশি তাই করে যাচ্ছে। ফলে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রধান প্রসিকিউটর ফাতু বেনসুদা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তুলেছেন। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরাইলের ক্ষেপণাস্ত্র ফিলিস্তিনিদের এপার্টমেন্টে আঘাত করে আরো হতাশার জন্ম দিয়েছে। সেখানে পবিত্র ঈদের দিনে আটটি শিশু ও দু’জন নারীকে হত্যা করেছে। ইসরাইলের বক্তব্য, শুক্রবারের ওই হামলায় হামাসের সিনিয়র এক কমান্ডারকে টার্গেট করা হয়েছিল। কিন্তু ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে- ফিলিস্তিনিরা ওই ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে বিভিন্ন জিনিস টেনে বের করছেন। এর মধ্যে ছিল শিশুদের খেলনা। একটি মনোপলি গেমসের বোর্ড। এ ছাড়া উদ্ধার করছেন মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া ভবন থেকে রক্তাক্ত মৃতদেহ। এ হামলায় বেঁচে আছে শুধু একটি নবজাতক ছেলে শিশু। তাহলে ইসরাইলের দাবি করা সেই হামাস কমান্ডার কই? এ প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? ওই শিশু সন্তানটির কাছেই বা বিশ্ববাসী কি জবাব দেবে।

শিশুটির পিতা মোহাম্মদ আল হাদিদি ছিলেন বাইরে। তাকে পরে এক হাসপাতালে দেখা গেছে। তিনি এই ছোট্ট শিশুর হাত ধরে আছেন। বলছেন, আহ্‌ আমার ভালোবাসা। এ খবরের পরেই নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে, ইসরাইল এবং গাজা উপত্যকার হামাসের মধ্যে সর্বশেষ সহিংসতার মূল্য দিচ্ছে বেসামরিক মানুষ। এসব দৃশ্যের পর প্রশ্ন সৃষ্টি হয়, এই অগ্নিকুণ্ডে যুদ্ধাপরাধের আইন কীভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে? সেনাবাহিনীর কোন অভিযানকে আইন দিয়ে বৈধতা দেয়া যায়? কি ধরনের যুদ্ধাপরাধ হচ্ছে এবং কে সেই যুদ্ধাপরাধ করছে? যদি কেউ এটা করেন তাহলে তাকে বা তাদেরকে কি কখনো বিচারের আওতায় আনা হবে?

উভয় পক্ষই দৃশ্যত এসব আইন লঙ্ঘন করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ পর্যন্ত হামাস কমপক্ষে ৩ হাজার রকেট ছুড়েছে ইসরাইলে। এটা পরিষ্কারভাবে যুদ্ধাপরাধ। আবার ইসরাইল বলছে- তারা বেসামরিক লোকজনকে হতাহত এড়াতে ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু তারা গাজায় তীব্র করেছে বোমা হামলা। হত্যা করছে পরিবারের পর পরিবারকে। মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছে ভবনের পর ভবন। এতে তারা যে অসম শক্তি ব্যবহার করছে তা ফুটে উঠেছে। এটাও যুদ্ধাপরাধ। এ পর্যন্ত গাজায় যেসব ভয়াবহ হামলা চালিয়েছে ইসরাইল, তার মধ্যে অন্যতম রোববারে কয়েকটি ভবনকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া। এতে কমপক্ষে ৪২ জন মানুষ মারা গেছেন। এর মধ্যে কমপক্ষে ১০টি শিশু। এই লড়াইয়ের পক্ষে কোনো বৈধতা দেয়া যায় না। তবে কিছু বিষয় পরিষ্কার। তা হলো, গাজায় গিজগিজ করে বসবাস করেন প্রায় ২০ লাখ মানুষ। সেখানে ইসরাইল আকাশ পথে এবং স্থলপথে যে হামলা করেছে তাতে ৯২ নারী ও শিশুসহ কমপক্ষে ১৯৭ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সোমবার ও রোববার সন্ধ্যায়। এর ফলে ধ্বংসযজ্ঞের ভয়াবহ দৃশ্য সারা বিশ্বে অনুরণন তুলেছে।

ইসরাইলের পত্রিকা টাইমস অব ইসরাইলের রিপোর্টে বলা হচ্ছে, গাজার ধ্বংসস্তূপের নিচে জীবিত মানুষের আর্তনাদ। রোববার সকালে ইসরাইলে হামলায় গাজায় নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ৪২ জন। এর মধ্যে একটি এক বছরের শিশু এবং একটি তিন বছরের শিশু রয়েছে। বিভিন্ন ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ে আছে মৃতদেহ বা জীবিত কেউ। তাদের সন্ধানে অনবরত উদ্ধার অভিযানে কাজ করে যাচ্ছে প্যারামেডিক অথবা উদ্ধারকারী ক্রুরা।
বসনিয়া অঞ্চলের সরকারগুলো ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কড়া সমালোচনা করেছে। কারণ, তার হামলাকে বসনিয়া সমর্থন করছে বলে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু এর জবাব দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্সি সেফিক জাভেরোভিচ। তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কাছে আমার বার্তা হলো- বসনিয়া এবং হার্জেগোভিনা কখনোই ইসরাইলের সামরিক বাহিনীর হামলায় গাজায় নিরপরাধ মানুষকে হত্যায় সমর্থন করে না। বসনিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিসেরা তুর্কোভিচ বলেছেন, ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যে শুধু শান্তি প্রতিষ্ঠা ও তার জন্য গৃহীত পদক্ষেপকে সমর্থন করে।

ওদিকে কানাডার মন্ট্রিলে ইসরাইলপন্থি ও ফিলিস্তিনপন্থিদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এর নিন্দা জানিয়েছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। তিনি এক টুইটে বলেছেন, অবাধে কানাডায় যে কেউ শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করতে এবং মত প্রকাশ করার অধিকার আছে। কিন্তু আমরা ইসলামবিরোধিতা এন্টিসেমিটিজম অথবা কারো বিরুদ্ধে কোনো ঘৃণা সহ্য করবো না।

এ জাতীয় আরো সংবাদ

মুসলিম খেলোয়াড়দের সমর্থনে ‘অ্যাথলিট চার্টার’ প্রকাশ

আনসারুল হক

‘লাকি সিনেমা হল’ এখন ‘ক্যাডেট মাদরাসা’ খুশি স্থানীয়রা

নূর নিউজ

ইসরাইলের বিরুদ্ধে লন্ডনে ফিলিস্তিনিদের বিক্ষোভ

নূর নিউজ