সুফিয়ান ফারাবী
প্রতিবেদক
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া একটি ফেসবুক লাইভ ভিডিওতে দেখা গেছে অভিনেতা রিয়াজের শ্বশুর জনৈক মহসিন তার নিজ আগ্নেয়াস্ত্র দারা আত্মহত্যা করেছেন। ভিডিওটিতে তাকে বলতে শোনা গেছে, “আমি ক্যান্সার আক্রান্ত। আমার ব্যবসা এখন বন্ধ। আমি বাসায় একাই থাকি। আমার এক ছেলে থাকে অস্ট্রেলিয়ায়। আমার ভয় করে যে আমি বাসায় মরে পড়ে থাকলে, লাশ পঁচে গেলেও কেউ হয়তো খবর পাবে না।” । ফেসবুক লাইভে দেয়া তার এই বক্তব্যের সূত্র ধরে অনেকেই ভাবছেন তার আত্মহত্যার মূল কারণ নিঃসঙ্গতা। স্ত্রী পরিবার-পরিজন ছেলে মেয়ে ছাড়া দীর্ঘদিন তিনি একাকী জীবন যাপন করছিলেন। আর এই নিঃসঙ্গতার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।
বর্তমান সময়ে এমন অসংখ্য খবর পত্রিকার পাতায়, টেলিভিশনের স্ক্রলে বা অনলাইনে ব্রেকিংয়ে দেখা যায়। যার কারণ হিসেবে পারিবারিক সম্পর্কের মাঝে দূরত্ব ও একাকীত্বকে উল্লেখ করছেন বিশিষ্টজনেরা। বিষয়টি নিয়ে নূর নিউজ কথা বলেছে কয়েকজন বিশিষ্ট জনের সাথে।
বাবা-মা সন্তানকে সময় দিতে হবে, সন্তানকেও বাবা-মার সব বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে: মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী মনে করেন, এ ধরনের সমস্যা দূর করতে পিতা-মাতা ও সন্তানদের আলাদা আলাদা ভূমিকা রাখতে হবে।
প্রথমত সন্তান যখন ছোট থাকে তখন পিতা মাতার উপর আল্লাহ প্রদত্ত যেসব দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তা যথাযথভাবে পালন করতে হবে। সন্তানকে প্রচুর সময় দিতে হবে। তাকে ভালো আর মন্দের পার্থক্য বোঝাতে হবে। নানা বিষয়ে কাউন্সেলিং করতে হবে। এমন ভাবে তার মেজাজ গড়ে তুলতে হবে যাতে যেকোন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে ভালো-মন্দ আলাদা করতে পারে। কখনোই সন্তান থেকে নিজেকে দূরে রাখা যাবে না। কোনভাবেই যেন সন্তান মাতৃস্নেহ ও পিতার অভিভাবকত্ব থেকে দূরে না থাকে। পিতা-মাতার যদি এসব বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেয় তাহলে সন্তানের মানসিক দিক উন্নীত হবে। যা ভবিষ্যতে সারা জীবনের জন্য তার পথের পাথেয়র মত।
তেমনি ভাবে পিতা-মাতা যখন তার দায়িত্ব পালন করে বয়সের একটা পর্যায়ে পৌঁছাবে তখন সে যদি নিঃসঙ্গতায় থাকে তাহলে তার চেয়ে বড় অভিশাপ সন্তানের জন্য আর কিছু হতে পারে না। সন্তানকে অবশ্যই পিতা-মাতার স্বাস্থ্য, মানসিক বিষয় সব বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। এ ধরনের আত্মহত্যা বা করুণ মৃত্যু সমাজে দিন দিন বাড়ার কারণ দূরত্ব। দূরত্ব কমে গেলে এ ধরনের ঘটনাও কমে যাবে।
বয়স্কদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ভাবে বিয়ের প্রতি উৎসাহিত করা দরকার: মাওলানা ইউসুফ নূর
কাতার ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ইমাম ও আল নূর কালচারাল সেন্টার কাতারের নির্বাহী পরিচালক মাওলানা ইউসুফ নূর বলেন, পাশ্চাত্য সভ্যতার ভালো দিকগুলো আমাদের সামনে তুলে ধরা হলেও এর কুৎসিত দিকগুলো সচরাচর মিডিয়ায় আসে না। জীবনের সব কিছু পেয়েও শেষ বয়সে তারা হতাশায় ভোগে। জীবনে কী পেলাম, কী পেলাম না এই প্রশ্ন তাদেরকে তাড়া করে বেড়ায়। জাপান ও ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে আত্মহত্যার অধিক প্রবণতা স্পষ্টভাবে এ বিষয়টি বুঝিয়ে দেয়।
মাওলানা ইউসুফ নূর এই সমস্যা দূর করতে ৩ টি প্রস্তাবনা দিয়েছেন। প্রথমত যারা বিপত্নীক বা বিধবা তাদের বিবাহের ব্যবস্থা করা। রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিকভাবে তাদেরকে উৎসাহিত করে নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য এই পদক্ষেপ অত্যন্ত ভালো ভূমিকা রাখবে বলে তিনি মনে করেন।
প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন আহমেদের দ্বিতীয় বিয়ের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, তার বিয়ে যেভাবে তার ছেলেমেয়েরা মেনে নিয়েছে, এবং খুশি হয়েছে, এটা খুবই আশাব্যঞ্জক। বাবা-মার একাকীত্বতা ছেলে মেয়েদের বোঝা উচিত। আমি তো মনে করি ছেলেমেয়েদের উপর দায়িত্ব হয়ে পড়ে বিপত্নীক বাবা অথবা বিধবা মায়ের বিয়ের ব্যবস্থা করা যদি তারা চান।
দ্বিতীয়তঃ যারা বিয়ের জন্য সক্ষম নন, তাদের জন্য ধর্মীয় পরিবেশে আবাসিক ব্যবস্থা করা দরকার। মাদ্রাসা অথবা খানকা কর্তৃপক্ষ এ বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নিতে পারেন। তাতে দ্বীনি পরিবেশে থাকার কারণে তাদের একাকীত্বভাব দূর হয়ে যাবে।
তৃতীয়তঃ বাংলাদেশ ইসলামী বা অনৈসলামিক এনজিওগুলো বিপত্নীক পুরুষ ও বিধবা মহিলাদের ডাটাবেজ তৈরি করে তাদের পরস্পরের সম্পর্ক করে দিতে পারেন। যেহেতু বিষয়টি সামাজিকভাবে এখনো অপছন্দনীয় সুতরাং সামাজিক সংগঠনগুলোর এগিয়ে আসা উচিত।
পারিবারিক বন্ধন আরো মজবুত করা প্রয়োজন: মুফতি মুহাম্মদ ইসমাইল
যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী আলেম আন-নূর কালচারাল সেন্টারের পরিচালক মুফতি মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, এ ধরনের মৃত্যুর সংবাদ আমরা হয়তো শুনতে পেতাম না যদি একাকিত্বকে সঙ্গী করে চলা মানুষগুলোর পাশে তাদের আত্মীয়-স্বজন ও পরিবার পরিজন বসবাস করতেন। শেষ বয়সের মানুষের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সঙ্গ। অর্থবিত্ত ধন-সম্পদ অথবা যশ-খ্যাতির চেয়েও মানুষ সে সময়ে নিঃসঙ্গতা থেকে দূরে থেকে সঙ্গী বা একান্ত মানুষের সঙ্গে সময় কাটাতে চায়। তা না হলে মানুষ ধীরে ধীরে মানসিকভাবে প্রচন্ড চাপ অনুভব করে। একটা সময় এই চাপ সহ্যের সীমানা অতিক্রম করে। সে সময় উপায়ন্তর না খুঁজে পেয়ে নানা ধরনের ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। এজন্য প্রয়োজন পরিবারের মানুষগুলো একসঙ্গে থাকা, প্রতিনিয়ত খোঁজখবর ও ভালোবাসা বিনিময় করা।
আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে: শওকত আলী সাগর
দৈনিক নতুন দেশের প্রকাশক ও সম্পাদক সাংবাদিক শওকত আলী সাগর মনে করেন, আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশনে মিডিয়াকে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। পশ্চিমা মিডিয়া অধিকাংশ আত্মহত্যার সংবাদই এড়িয়ে যায়। যেগুলো প্রকাশ করে, সেগুলোর পরিবেশনা এমন হয়- যাতে সেই খবর পড়ে কেউ উদ্বুদ্ধ না হয়। একটি আত্মহত্যার খবর যাতে আর কারো জন্য ’ইনসপায়ারিং’ না হয়- মিডিয়াকে সেদিকে নজর রাখতে হয়। এখানে মিডিয়ার দায়িত্বশীলতার প্রশ্ন জড়িত।
আত্মহত্যার খবরে কীভাবে তিনি আত্মহত্যা করলেন তার বিশদ বিবরণ অপ্রয়োজনীয়ই কেবল নয়, আমার কাছে মনে মন্দ সাংবাদিকতা। সাংবাদিকতার শিক্ষক, পেশাদার সাংবাদিকদের ভিন্ন মতামত থাকতে পারে, সেগুলো নিয়ে তর্ক, আলোচনাও হতে পারে। আমার কাছে মনে হয়েছে, আত্মহত্যার সংবাদ পড়ে কারো যেনো মনে না হয়- ও আচ্ছা, তা হলে আমি না কেন! এটি যেনো কারো জন্য ইন্সপায়ারিং ইভেন্ট না হয়ে ওঠে। মিডিয়ার সেই দায় আছে, তাকে সেই দায়িত্ব নিতে হয়।