সয়াবিন ও পাম তেলের উৎপাদন ও বাজারজাত পর্যায়ে ২০ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে। সোমবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এ-সংক্রান্ত এসআরও জারি করে। এর আগে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ভোজ্যতেলের ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহারের নির্দেশ দেওয়া হয়।
ভ্যাট প্রত্যাহারের ফলে সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম ১৩৩ ও ১৬৮ টাকার চেয়ে লিটারপ্রতি দুই-তিন টাকা কমতে পারে। এদিকে নিত্যপণ্যের দ্রুত এলসি খুলতে সরকারি ব্যাংকগুলোকে চাহিদা অনুযায়ী ডলারের জোগান দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গত ১০ মার্চ কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিত্যপণ্য আমদানিতে এলসি মার্জিন প্রত্যাহার করে। একই সঙ্গে এলসি কমিশনও সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখার নির্দেশনা দিয়েছে। এর প্রভাবে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।
পণ্যের দাম কমাতে সরকারের দেওয়া বিভিন্ন ধরনের ছাড়ের সুবিধা ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে তদারকি বাড়ানো হবে। একই সঙ্গে বন্দর থেকে দ্রুত পণ্য খালাসের ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। এছাড়া পণ্যমূল্য তদারকিতে সরকার ট্রাস্কফোর্স গঠন ও আদালত সয়াবিন তেল নিয়ে কারসাজি ভেঙে দেওয়ার কথা বলেছেন।
করোনার পর আসন্ন রমজান ঘিরে পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়ছে। স্থানীয় বাজারে এর প্রভাব পড়েছে। সব ধরনের পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সয়াবিন তেলের দাম।
প্রায় প্রতিবছরই রোজায় এ পণ্যের চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে যায়। ফলে ভোক্তার ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। এবার পণ্যের দাম কমাতে সরকার থেকে নানামুখী ছাড় ও পদক্ষেপ নেওয়া হলেও এখনো কমতে শুরু করেনি। তবে পেঁয়াজের দাম সামান্য কমেছে।
এ অবস্থায় সরকারের দেওয়া বিভিন্ন ছাড়ের সুবিধা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তিন মাস আগে থেকেই আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় বাজারে পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করে। সরকার আগে এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, এমন কথা বলছেন অনেকেই।
তাদের মতে, রোজা শুরুর মাত্র ১৭ দিন আগে সয়াবিন তেলের উৎপাদন ও বিপণন পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে। ২০ দিন আগে এলসি মার্জিন প্রত্যাহার ও এলসি কমিশন কমানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।
এ সুবিধায় সয়াবিন ও পাম তেল বাজারে আসার আগেই রমজান প্রায় শেষ হয়ে যাবে। কারণ ভ্যাট প্রত্যাহারের ফলে আমদানি করা অপরিশোধিত সয়াবিন তেল কারখানায় পরিশোধন শেষে ডিলার, পাইকারি বাজার ও বিভিন্ন হাত ঘুরে খোলাবাজারে আসতে ৩৫ থেকে ৪০ দিন সময় লাগবে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি সময় লাগতে পারে। কাজেই সোমবার যে ভ্যাট প্রত্যাহার হলো তার বিপরীতে তেল বাজারে আসতে এপ্রিল মাসের শেষ দিক চলে আসবে। অর্থাৎ রোজা প্রায় শেষ হয়ে যাবে।
এদিকে বাজারে যে সয়াবিন তেল রয়েছে সেগুলো ব্যবসায়ীরা আগের দামেই বিক্রি করছে। ভ্যাট কমানোর ফলে নতুন তেল আসতে আরও যে সময় লাগছে এর আগে দাম কমার সম্ভাবনা নেই। সয়াবিন ও পাম তেল আমদানিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
উৎপাদন পর্যায়ে যে মূল্য সংযোজন হয় তার ওপর ১৫ শতাংশ এবং উৎপাদনের পর বাজারজাত করলে যে মূল্য সংযোজন হয় তার ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপিত রয়েছে। এই দুই পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহার করে সোমবার এনবিআর প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।
এ সুবিধা ৩০ জুন পর্যন্ত মিলবে। কোম্পানিগুলোর মতে, প্রতি লিটারে ২ থেকে ৩ টাকা দাম কমতে পারে। তবে আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহার করলে দাম আরও বেশি কমত বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।
এ বিষয়ে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ভোজ্যতেলের দাম পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো নির্ধারণ করে না। এটি ট্যারিফ কমিশন নির্ধারণ করে দেয়। উৎপাদন ও বিপণন পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহারের ফলে বাজারে দাম কেমন হবে তা তারাই ভালো বলতে পারে।
তিনি আরও বলেন, প্রতি লিটার ভোজ্যতেলে ২৭-২৮ টাকা ভ্যাট দিতে হয়। এর মধ্যে আমদানি পর্যায়েই ২০ টাকা দিতে হয়। বাকিটা উৎপাদন ও বিপণন পর্যায়ে। আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহার করলে বাজারে তেলের দাম আরও কমত বলে মনে করেন তিনি।
একই কথা জানিয়ে মেঘনা গ্রুপের জ্যেষ্ঠ সহকারী মহাব্যবস্থাপক তাসলিম শাহরিয়ার বলেন, উৎপাদন ও বিপণন পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহারের কারণে বাজারে তেলের দাম কমবে বলে যে বার্তা দেওয়া হচ্ছে, তা পুরোপুরি সঠিক নয়।
এক লিটার সয়াবিন তেলে উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট ১ থেকে দেড় টাকা, যা একেবারেই সামান্য। প্রকৃতপক্ষে আমদানি পর্যায়ে বেশি ভ্যাট দিতে হয়। আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহার করা না হলে বাজারে প্রকৃত সুফল পাওয়া যাবে না।
এদিকে সরকারি ব্যাংকগুলো কম দামে ডলারের জোগান দিলে, মার্জিন ছাড়া এলসি এবং কমিশন কম নিয়ে যেসব এলসি এখন খোলা হবে, সেগুলোর পণ্য দেশে আসতে কমপক্ষে তিন মাস সময় লাগতে পারে।
এগুলো বন্দর থেকে খালাস হয়ে কোম্পানিতে যেতে আরও ১৫ থেকে ২০ দিন সময় লাগবে। এ ছাড়া এগুলো উৎপাদন হয়ে বাজারে আসতে আরও ৩৫ থেকে ৪০ দিন সময় লাগবে। সবমিলে এ খাতে ৪ থেকে ৫ মাসের প্রয়োজন।
তবে এর মধ্যে যদি পরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি করেন, সেগুলোও দেশে আসতে কমপক্ষে ২ মাস সময় লাগবে। সেগুলো বাজারে আসতে আরও কমপক্ষে এক মাস লাগতে পারে। ফলে সয়াবিনের ক্ষেত্রে যেসব ছাড় দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর সুবিধা রোজার মধ্যে পাওয়া কঠিন।
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ভোজ্যতেলের ওপর ভ্যাট প্রত্যাহারের সুবিধা ভোক্তা পর্যায়ে পেতে আরও ৬ থেকে ৭ সপ্তাহ লাগবে।
সুবিধা পেতে রোজার অর্ধেকের বেশি সময় চলে যাবে। এ সিদ্ধান্ত আরও আগে নেওয়া দরকার ছিল। এতে রাজস্ব আয়ে কিছুটা ক্ষতি হবে। তবে অন্যান্য পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে সেখান থেকে এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে।
এখন পর্যন্ত ভ্যাট প্রত্যাহারের পর ব্যবসায়ীরা মূল্য না কমালে ফোর্স করে কমাতে হবে। ভ্যাট প্রত্যাহারের সুবিধা অবশ্যই ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছতে হবে। এর পরও যদি পণ্যের দাম বাড়ানো হয়, সে ক্ষেত্রে অবশ্য যুক্তিসংগত কারণ থাকতে হবে।
সূত্র জানায়, ছোলা, ডাল, পেঁয়াজ, মসলাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে ডলার, এলসি মার্জিন ও কমিশনে যে ছাড় দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে রোজায় সুবিধা পাওয়া কঠিন। তবে পেঁয়াজের দাম কমছে দেশি পেঁয়াজ বাজারে চলে আসার কারণে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, সয়াবিন ও পাম তেলের উৎপাদন ও বিপণন পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহার করায় কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাবে সরকার।
সংশ্লিষ্টরা প্রশ্ন তুলেছেন, ভ্যাট প্রত্যাহারের এ সুবিধা ভোক্তারা পাবে কি না? এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, ভোক্তার জন্য সরকারের দেওয়া বিশেষ ছাড়ের সুবিধা যাতে তারা পায়, সেটি নিশ্চিত করতে তদারকি আরও বাড়ানো হবে।
আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের দাম বাড়ায় ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে সরকার প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন ১৬৮ টাকা, খোলা তেল ১৪৩ টাকা ও পামওয়েল ১৩৩ নির্ধারণ করেছে।
এরপর ব্যবসায়ীরা প্রতি লিটারে আরও ১২ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করলে তা নাকচ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এরপর বাজার থেকে সয়াবিন তেল উধাও হয়ে যায়।
দামও বেড়ে প্রতি লিটার ২০০ টাকায় ওঠে। এরপর থেকে প্রশাসন ও ভোক্তা অধিদপ্তর অভিযান শুরু করলে দাম বৃদ্ধি রোধ হয়েছে। কিন্তু এখনো বোতলজাত সয়াবিন প্রতি লিটার ১৮০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে গত রোববার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির এলসি দ্রুত খোলা এবং এগুলো দ্রুত বিদেশি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে পাঠানোর জন্য।
একই সঙ্গে সরকারি ব্যাংকগুলোয় বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ে ডলারের দাম কম। এ কারণে সরকারি ব্যাংকে নিত্যপণ্যের এলসি খুলতে ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করার জন্য বলা হয়েছে।
সরকারি ব্যাংকগুলোয় এলসি খোলার জন্য ডলারের দাম ৮৬ টাকা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় ৮৭ থেকে ৮৮ টাকা। অন্যান্য ফি ও চার্জও সরকারি ব্যাংকে কম।