আমাদের দেশে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই মাদরাসা শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। পুরুষ মাদরাসার পাশাপাশি নারীদের জন্যও দেশের আনাচে-কানাচে গড়ে উঠেছে হাজারো মহিলা মাদরাসা। কারণ আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে নারীদের ভূমিকা অপরীসিম। নারী-পুরুষ একে অপরের পরিপূরক।
প্রতিবছর হাজার হাজার নারী-পুরুষ দাওরায়ে হাদিস শেষ করছে। আলেমরা যেমন দীনি কাজে পেশাদার হচ্ছেন, তেমনিভাবে অনেক নারীও মাদরাসায় শিক্ষকতা করছেন। সবচে’ বড় কথা হলো, একজন মাদরাসা পড়ুয়া মেয়ে সাংসারিক জীবনে তার সন্তানের যাবতীয় দীনি চাহিদা ও জ্ঞান পূরণে ভূমিকা পালন করছেন।
কিন্তু অভিভাবকদের অভিযোগ, গুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠানের উন্নতি ও মহিলা মাদরাসা পড়ুয়া নারীদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ে না। অথচ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পর্যায়ক্রমে মহিলা মাদরাসার উন্নতির জন্য কাজ করা উচিত, সিলেবাস ও কাঠামোগত সম্পাদনাও জরুরি।
এ বিষয়ে দেশের মুরুব্বি আলেম ও বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকের হস্তক্ষেপ চাইলেন রাজধানীর অদূরে মানিকগঞ্জ জেলার আবু হুরায়রা রাযি. মহিলা মাদরাসার প্রিন্সিপাল ও হজরত আবরারুল হক রহ.-এর খলিফা মাওলানা সাঈদ নূর।
তিনি বললেন, আমাদের দেশের মহিলা মাদরাসাগুলো নিয়মতান্ত্রিক হওয়া দরকার। বেফাক বোর্ড ও মুরুব্বিদের আওতায় আনা প্রয়োজন। মুরুব্বীদের তত্ত্বাবধানে মাদরাসা পরিচালিত হওয়া অপরিহার্য। অধিকাংশ মাদরাসাই বেফাকের বাইরে। কোন নির্দিষ্ট মুরুব্বির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত নয়। তাই আমার ধারণা, আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ছাত্রীরা আশা অনুপাতে ভূমিকা রাখতে পারছে না। যদি সঠিক তত্ত্বাবধানে থাকে, তবে আমার বিশ্বাস- মহিলা মাদরাসাগুলোর সফলতা ও আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে তাদের ভূমিকা প্রশংসনীয় হয়ে উঠবে।’
‘অধিকাংশ মহিলা মাদরাসা ভাড়া বাসায় চলে। এটা প্রাতিষ্ঠানিক বাণিজ্যিকীকরণের একটি মাধ্যম হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এজন্য মহিলা মাদরাসার জন্য স্থায়ী ভূমি ও দালান প্রয়োজন। এছাড়াও যোগ্য শিক্ষিকা ও নারী বান্ধব পরিবেশ থাকটাও জরুরি।’ যোগ করেন মাওলানা সাঈদ নূর।
মহিলা মাদরাসা সমৃদ্ধকরণের ক্ষেত্রে কয়েকটি সমস্যার কথা উল্লেখ করলেন সাভারের জামিয়াতুল আকবর মহিলা মাদরাসার প্রিন্সিপাল মুফতি আলী আকরাম। তিনি বলছেন, কিছু সমস্যার কারণে মাদরাসা পড়ুয়া মেয়েদের যথাযথভাবে মেধা ও প্রতিভা বিকাশ হচ্ছে না।
‘প্রথমত সমস্যা দৃষ্টিভঙ্গির, মূলত এটাই প্রধান সমস্যা। আর এ সমস্যার কারণে আরও অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। যেমন, অনেক অভিভাবক মনে করেন, মেয়েরা সংসার পরিচালনায় অর্থনৈতিকভাবে কোন অবদান রাখবে না তাই বেশি পড়াশোনার প্রয়োজন নেই।’ যোগ করেন তিনি।
মুফতি আলী আকরাম আরও কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরেন, ‘অধিকাংশ মাদরাসার পরিচালক বা মুহতামিম ভালোমানের আলেম না হওয়া, শিক্ষাকে শুধুমাত্র বাণিজ্যিকীকরণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা, ভালো মানের পেশাদার শিক্ষিকার স্বল্পতা, শিক্ষিকাদের বেতনের পরিমাণ কম হওয়া, আরবি ভাষার উপর গুরুত্ব কম দেওয়া, শ্রেণী ও শিক্ষা সিলেবাস সংকীর্ণ হওয়া, পাঠ্যক্রমিক ব্যবস্হাপনা কম থাকা, ইসলাহী প্রোগ্রাম ও তারবিয়াতের মজলিসের অপ্রতুলতা।’
শিক্ষার সিলেবাস কে সম্প্রসারণ করা, যোগ্য ব্যক্তিদের হাতে পরিচাালনা হওয়া, ভালো মানের নুরানি বোর্ড গঠন করা, শিক্ষিকাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, সম্পূর্ণ নারীবান্ধব পরিবেশের প্রতি গুরুত্বারোপ করা, পেশাদার শিক্ষিকা তৈরীর লক্ষ্যে বেতনের পরিমাণ বৃদ্ধি করা, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, হস্ত শিল্প, ক্ষুদ্র কুটিরশিল্প, রাধুনী শিল্প ইত্যাদি গার্হস্থ্য ও অর্থনীতি বিষয়ে বিভিন্ন মেয়াদী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে মহিলা মাদরাসার ছাত্রীরা আরও বেশি ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন মুফতি আলী আকরাম।
দেশের সকল মহিলা মাদরাসার জন্য স্বতন্ত্র বোর্ড গঠন করা জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন সাভারের আরেক মাদরাসা সায়্যিদাতুন নিসা মহিলা মাদরাসার প্রিন্সিপাল ও মাসিক শরিয়াকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক মুফতি এহসানুল হক।
তিনি বললেন, একজন মহিলা মাদরাসার প্রিন্সিপাল হিসেবে মহিলা মাদরাসা অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য আমি দেশের সকল মহিলা মাদরাসা পরিচালনার জন্য স্বতন্ত্র একটি বোর্ড গঠন করার কথা বলব। যে বোর্ডের নেতৃবৃন্দ মহিলা মাদরাসার শিক্ষা ও পরিবেশের উন্নতি নিয়ে ভাববে।
‘প্রয়োজনে বেফাক থেকে আলাদা করে মহিলা মাদরাসার জন্য আলাদা বোর্ড গঠন করা যেতে পারে। যার নেতৃত্বে ও তত্ত্বাবধানে দেশের শীর্ষ মুরব্বিরা থাকবেন, পরিচালনায় তরুণ আলেম সমাজ শ্রম দিবেন। মহিলা মাদরাসার সমস্যা নিয়ে আলাদা করে ভাবার প্রয়োজন। এজন্যই আলাদা একটি বোর্ডের গুরুত্ব আমার কাছে উপলব্ধি হয়েছে। বোর্ডে নেতৃবৃন্দ সিলেবাসসহ যাবতীয় সমস্যা নিয়ে ভাববেন এবং মুরুব্বী আলেমদের পরামর্শে সে সমস্ত সমস্যা নিরসনে কাজ করবেন।’ যোগ করেন মুফতি এহসানুল হক।