ভোরের আগেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার আত্মীয় ও মন্ত্রিসভার সদস্য আবদুর রব সেরনিয়াবাতের হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে যান। তখন বঙ্গবন্ধু ওপর থেকে নিচতলায় তার ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুল ইসলামকে টেলিফোন করে বলেন, সেরনিয়াবাতের বাসায় দুষ্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছে। দ্রুত পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করতে হবে। কিন্তু পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করেও কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি। একপর্যায়ে ঘাতকদের মুখোমুখি হন তিনি। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়ির দোতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নিচতলায় নামতে নামতে বঙ্গবন্ধু খুনিদের উদ্দেশে বলেন, ‘এই বেয়াদবি করছিস কেন? তোরা কী চাস?’
১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী, জাতির পিতার ব্যক্তিগত সহকারী আবদুর রহমান শেখ রমা ভয়াল সেই রাতের স্মৃতি এভাবেই বর্ণনা করেন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ভোরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রান্ত হওয়ার সময় বঙ্গবন্ধুর ঘরের পাশে বারান্দায় ঘুমিয়েছিলেন আবদুর রহমান শেখ রমা। এ সময় তার বয়স ছিল বারো। কিশোর রমা নয় বছর বয়সি শেখ রাসেলের খেলার সঙ্গী ছিলেন। তাকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও খুব ভালোবাসতেন। এই রমা বঙ্গবন্ধু পরিবারের দুঃসময়ে কখনো দূরে থাকেননি। পঁচাত্তর-পরবর্তী দুঃসময়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দিল্লির নির্বাসনকালীনও রমা তার সঙ্গে ছিলেন। এখন প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে দায়িত্ব পালন করছেন আবদুর রহমান শেখ রমা। বঙ্গবন্ধু হত্যার দায়ে যে মামলা করা হয়, তার দ্বিতীয় সাক্ষী ছিলেন রমা। তিনি শনিবার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর) যুগান্তরের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন।
মৃত্যুর আগেও জাতির পিতার কথায় দেশের মানুষের প্রতি গভীর বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ ছিল। একজন অভিভাবক সন্তানদের প্রতি যতটা আস্থা রাখেন, বঙ্গবন্ধু তেমনই বিপথগামী সেনাদের প্রতিও তেমন আস্থার সুরে কথা বলেন বলে জানান আবদুর রহমান রমা। তিনি বলেন, কিন্তু ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে সেই মর্যাদা দেয়নি। তারা অবলীলায় পিতার বুক লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে তাকে হত্যা করে। ওই কালরাত্রিতে শুধু বঙ্গবন্ধুই নন, ঘাতকদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি বঙ্গবন্ধুর আদরের সন্তান শিশু রাসেলও। নির্দয়ভাবে রাসেলকে হত্যা করার আগে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের সব সদস্যকে হত্যা করে খুনিরা।
রমা জানান, ভোরে বাড়িটির দক্ষিণ দিক থেকে অতর্কিত আক্রমণ শুরু হয়। এ সময় বঙ্গবন্ধু তার ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসেন। বেগম ফজিলাতুন নেছার কথায় তিনি (রমা) নিচে নেমে মেইন গেটের বাইরে এসে দেখেন সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য গুলি করতে করতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে এগোচ্ছে। তখন রমা বাড়ির ভেতর ফিরে যান এবং দেখেন লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরিহিত বঙ্গবন্ধু নিচতলায় নামছেন। এ সময় আতঙ্কিত বেগম ফজিলাতুন নেছা দোতলায় ছোটাছুটি করছিলেন। এই পরিস্থিতিতে কিশোর রমা তিনতলায় চলে যান এবং বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল ও তার স্ত্রী সুলতানা কামালকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেন। এরপর দ্রুত শার্ট-প্যান্ট পরে নিচতলায় নামেন শেখ কামাল। নিরাপদ আশ্রয়ের কথা ভেবে সুলতানা কামাল চলে যান দোতলায় বেগম ফজিলাতুন নেছার কাছে। পরে শেখ জামাল ও তার স্ত্রীকে ঘুম থেকে ডেকে তুললে তারাও দ্রুত জামা-কাপড় পরে বেগম ফজিলাতুন নেছার কক্ষে যান।
প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে অভ্যর্থনা কক্ষে বঙ্গবন্ধুর সামনেই বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে থাকেন ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুল ইসলাম। পুলিশ কন্ট্রোল রুম ও গণভবন এক্সচেঞ্জে চেষ্টার এক পর্যায়ে রিসিভার নিয়ে বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি।’ কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার কথা শেষ করতে পারেননি। তার আগেই ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি জানালার কাচ ভেঙে অফিসের দেওয়ালে লাগে। এ সময় বঙ্গবন্ধু টেবিলের পাশে শুয়ে পড়েন। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও বেগম ফজিলাতুন নেছা তাদের গৃহকর্মী আবদুলকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে তার পাঞ্জাবি ও চশমা পাঠিয়ে দেন।
আবদুর রহমান শেখ রমা বলেন, কিছুক্ষণ পর গুলিবর্ষণ থেমে যায়। তখন বঙ্গবন্ধু টেবিলের পাশ থেকে উঠে দাঁড়ান এবং আবদুলের হাত থেকে পাঞ্জাবি আর চশমা নিয়ে পরেন। নিচতলার এই ঘর থেকে বারান্দায় বের হয়ে বঙ্গবন্ধু দেখতে পান পাহারায় থাকা সেনা ও পুলিশ সদস্যরা আতঙ্কিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। তখন বঙ্গবন্ধু তাদের বলেন, ‘এত গুলি হচ্ছে, তোমরা কী করছ?’ এরপর বঙ্গবন্ধু ওপরে চলে যান। বঙ্গবন্ধু ওপরে ওঠার সময় রমা দেখতে পান শেখ কামাল নিচে নেমে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। আর তখনই খুনি বজলুল হুদা বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলের পায়ে গুলি চালায়। সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে বাঁচাতে লাফ দিয়ে ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢোকেন শেখ কামাল এবং নিজের পরিচয় দিয়ে বলতে থাকেন, ‘আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল।’ এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে শেখ কামালের শরীর লক্ষ্য করে গুলি চালায় বজলুল হুদা। বার্স্ট ফায়ারে ঝাঁজরা হয়ে যায় তার দেহ।
আবদুর রহমান রমা যুগান্তরকে বলেন, এমন নির্দয় হত্যাকাণ্ডের কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন জাতির পিতা। এই নৃশংসতা বুঝতে পেরে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে থাকেন। এই সময়েই ফোনে তার সামরিক সচিব কর্নেল জামিলকে পান। তিনি তাকে বলেন, ‘জামিল, তুমি তাড়াতাড়ি আসো। আর্মির লোকরা আমার বাসা অ্যাটাক করেছে। সফিউল্লাহকে (সেনাপ্রধান) ফোর্স পাঠাতে বলো।’ এরপর জেনারেল সফিউল্লাহকেও ফোন করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি তাকে বলেন, ‘সফিউল্লাহ তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে, কামালকে (শেখ কামাল) বোধহয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।’
এ সময় ঘাতকরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তারা গুলি করতে করতে বাড়ির ওপরতলায় উঠতে থাকে। গৃহকর্মী আবদুল বঙ্গবন্ধুর মেজো ছেলে শেখ জামালের ঘরের বাথরুমে আশ্রয় নিলে সেখানে গিয়ে তারা তাকে গুলি করে। হাতে ও পেটে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আবদুল সিঁড়ির পাশে গিয়ে হেলান দিয়ে বসে থাকেন। ওই সময় বঙ্গবন্ধুর ঘরে তিনি ছাড়াও ছিলেন বেগম ফজিলাতুন নেছা, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ঘরের বাইরে অবস্থান নেয়। গোলাগুলি থামলে বঙ্গবন্ধু দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন। এ সময় ঘাতকরা তাকে ঘিরে ধরে। মেজর মহিউদ্দিন ও তার সঙ্গের সৈন্যরা সিঁড়ি দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিচে নিয়ে যেতে থাকে। তখন ঘাতকদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তোরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে? বেয়াদবি করছিস কেন?’ এ সময় নিচতলা ও দোতলায় সিঁড়ির মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়িয়েছিল খুনি বজলুল হুদা ও নূর। বঙ্গবন্ধুকে নিচে নিয়ে আসার সময় নূর কিছু একটা বললে মহিউদ্দিন সরে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে বজলুল হুদা ও নূর তাদের স্টেনগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে। বঙ্গবন্ধুর বুকে ও পেটে গুলি লাগে। নিথর দেহটা সিঁড়ির ওপর পড়ে থাকে।
রমা জানান, তার কাছ থেকে গুলির কথা শুনে বেগম ফজিলাতুন নেছা, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, সুলতানা কামাল, রোজী জামাল, শেখ নাসের ও গৃহকর্মীরা বাথরুমে আশ্রয় নেন। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে নিচে নেমে এসে বেরিয়ে যায়। এরপর মেজর আজিজ পাশা ও রিসালদার মোসলেহউদ্দিন সৈন্যসহ বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে প্রবেশ করে। আজিজ পাশা তার সৈন্যদের নিয়ে দোতলায় যায় এবং ঘরের দরজায় গুলি করতে থাকে। পরে বেগম ফজিলাতুন নেছা দরজা খুলে তাদের না মারার জন্য অনুরোধ করেন। ঘাতকরা বেগম ফজিলাতুন নেছা, শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও তাকে নিচে নিয়ে আসার নির্দেশ দেয়। সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখেই বেগম ফজিলাতুন নেছা চিৎকার করে বলেন, ‘আমি যাব না, আমাকে এখানেই মেরে ফেল।’ এ সময় বেগম ফজিলাতুন নেছা সেখান থেকে যেতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে ঘরে ফিরিয়ে আনা হয়। শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও তাকে নিচে নিয়ে আসা হয়। বঙ্গবন্ধুর ঘরেই বেগম ফজিলাতুন নেছা, শেখ জামাল, সুলতানা কামাল ও রোজী জামালকে গুলি করে হত্যা করে ঘাতক আজিজ পাশা ও রিসালদার মোসলেহউদ্দিন। আর নিচে শেখ রাসেল, শেখ নাসের আর তাকে দাঁড় করানো হয়। পরে অফিসের সঙ্গে লাগোয়া বাথরুমে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় শেখ নাসেরকে।
লাইনে দাঁড়িয়ে শেখ রাসেল প্রথমে মহিতুল ইসলামকে জড়িয়ে ধরেন। তিনি বলেন, ‘ভাইয়া আমাকে মারবে না তো?’ মহিতুল জবাব দেন, ‘না ভাইয়া, তোমাকে মারবে না।’ এ সময় শেখ রাসেল তার মায়ের কাছে যেতে চাইলে আজিজ পাশা বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুলের কাছ থেকে জোর করে তাকে দোতলায় নিয়ে যেতে বলে। আজিজ পাশার কথা মতো এক হাবিলদার শেখ রাসেলকে দোতলায় নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে। রাসেলের চোখ বের হয়ে যায়। আর মাথার পেছনের অংশ থ্যাঁতলে যায়। তার দেহটি পড়ে থাকে সুলতানা কামালের পাশে। এভাবেই খুনিরা ইতিহাসের নৃশংস হত্যাকাণ্ড শেষ করে।